বাগ্যুদ্ধে বিএনপি ও জামায়াত
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী, যারা একসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন জোটসঙ্গী ছিল, তাদের মধ্যে বর্তমান দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ১৯৯৯ সালে চার দলীয় জোট গঠনের মাধ্যমে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল, তা ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে শক্তিশালী হয়। তবে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে এ সম্পর্ক ক্রমেই শিথিল হয়েছে।
বিরোধের কারণ
১. জোটের অকার্যকারিতা:
২০১২ সালে চার দলীয় জোটের সম্প্রসারণ হয়ে ২০ দলীয় জোট গঠিত হলেও এটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির নীতিনির্ধারকরা জোটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের বক্তব্যেও জোটের অকার্যকারিতা স্পষ্ট হয়েছে।
- ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল:
বিএনপি অভিযোগ করেছে যে জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে জামায়াত বিএনপির বিরুদ্ধে মোনাফেকির অভিযোগ তুলেছে, যা দুই দলের মধ্যে আস্থার সংকটকে বাড়িয়ে তুলেছে। - রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা:
বিএনপি একটি উদারপন্থী দল হলেও জামায়াতে ইসলামী ধর্মীয় রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দেয়। এ ভিন্নতা তাদের রাজনৈতিক কৌশলে মতপার্থক্য সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতিক বিবাদ
- রিজভীর সমালোচনা:
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জামায়াতকে উদ্দেশ করে তাদের কর্মকাণ্ডকে ‘মোনাফেকি’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, জামায়াত একাত্তরের বিরোধিতার ইতিহাস ভুলে বিএনপিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চায়। - জামায়াতের পাল্টা বিবৃতি:
জামায়াত রিজভীর মন্তব্যকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে। তাদের মতে, তারা সবসময় ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, যা বিএনপিকে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। - ফেসবুক যুদ্ধ:
দলীয় কর্মী-সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে সক্রিয় হয়েছেন। ফেসবুকে পাল্টাপাল্টি পোস্ট ও মন্তব্যে দুই দলের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ প্রকাশ পেয়েছে।
রাজনৈতিক প্রভাব
১. একক রাজনীতির প্রস্তুতি:
জামায়াতের সাম্প্রতিক অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে তারা এককভাবে রাজনীতি করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তাদের বক্তব্যে ২০ দলীয় জোটের অকার্যকারিতা প্রকাশ পায়।
- আলাদা রাজনৈতিক অগ্রাধিকার:
বিএনপি জাতীয় আন্দোলনে জামায়াতের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেয় না বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে। এতে জামায়াতের প্রভাব ও ভূমিকা আরো কমে আসতে পারে।
বিশ্লেষণ
বিএনপি ও জামায়াতের এই বিরোধ বাংলাদেশের রাজনীতিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
- জোট রাজনীতির ভবিষ্যৎ কি আদৌ কার্যকর থাকবে?
- রাজনৈতিক স্বার্থে আদর্শিক বিরোধ কিভাবে নিরসন সম্ভব?
বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্কের এই উত্তেজনা শুধু দলগুলোর জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতির জন্য একটি সংকেত। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কিংবা বিচ্ছিন্ন হওয়া উভয়ের জন্যই চ্যালেঞ্জ। আদর্শ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন করতে না পারলে জোটের অতীত গৌরব শুধু স্মৃতিতেই রয়ে যাবে।