শেখ হাসিনার শাসনামলের দুর্নীতি ও অর্থ পাচার নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ
ঐতিহাসিক অনুসন্ধান রিপোর্ট হস্তান্তর
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলের (২০০৯-২০২৪) অর্থনৈতিক অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের তিন মাসব্যাপী অনুসন্ধানের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। রোববার (১ ডিসেম্বর), প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের তেজগাঁও কার্যালয়ে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা) অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি, লুটপাট এবং আর্থিক কারচুপির যে ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে, তা জাতির জন্য আতঙ্কজনক বলে মন্তব্য করেছে কমিটি।
প্রতিবেদনের প্রধান বিষয়বস্তু
১. অর্থ পাচার ও দুর্নীতির মাত্রা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শাসনামলে অর্থনীতিকে ক্রোনি পুঁজিবাদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। নীতি প্রণয়ন, সরকারি প্রকল্প এবং আর্থিক খাতে অলিগার্কদের মাধ্যমে ব্যাপক লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
কমিটির সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান উল্লেখ করেন, তারা সাতটি বৃহৎ প্রকল্প পরীক্ষা করেছেন, যার আনুমানিক প্রাথমিক ব্যয় ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর ব্যয় নানা উপায়ে বাড়িয়ে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গেছে জমির মূল্য বেশি দেখানো, অতিরিক্ত উপাদান যোগ করা এবং ক্রয়ে কারচুপি করার কারণে।
২. বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)
অধ্যাপক একে এনামুল হক জানান, গত ১৫ বছরে এডিপিতে ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে, যার ৪০ শতাংশ অর্থ আমলারা লুটপাট করেছেন।
৩. কর অব্যাহতি ও বাজেট ব্যবস্থাপনা
কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, কর অব্যাহতির ফলে দেশের জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। এই অব্যাহতির অর্ধেক কমানো গেলে দেশের শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করা সম্ভব হতো।
৪. বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি
কমিটির সদস্য এম. তামিম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই বিনিয়োগের ১০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার অবৈধ লেনদেনে ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রতিবেদনের গুরুত্ব
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এই উদ্যোগকে “ঐতিহাসিক দলিল” হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, “এই রিপোর্ট শুধু প্রকাশ করা নয়, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সততা ও জবাবদিহিতার শিক্ষা দিতে সহায়তা করবে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “গত জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের অর্থনীতিকে আমরা যে ভঙ্গুর অবস্থায় পেয়েছি, তা এই রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। আমাদের গরিব মানুষের রক্ত-পানি করা টাকা যেভাবে লুটপাট হয়েছে, তা জাতিকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করবে।”
নিরপেক্ষ ও স্বাধীন অনুসন্ধান
কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানান, সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই কমিটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে। তিনি বলেন, “সমস্যার গভীরতা আমাদের প্রাথমিক অনুমানের চেয়েও অনেক বেশি। এই ৩০ অধ্যায়ের ৪০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে কীভাবে ক্রোনি পুঁজিবাদ নীতি প্রণয়নকে প্রভাবিত করেছে এবং দেশকে আর্থিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।”
প্রকাশের পরিকল্পনা
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা রিপোর্টটি শিগগিরই জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করার সুপারিশ করেছেন। এই রিপোর্ট জনসাধারণের কাছে পৌঁছালে অর্থনৈতিক দুর্নীতি রোধ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উপসংহার
দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের এই চিত্র জাতিকে আতঙ্কিত করার পাশাপাশি সচেতনতার জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে। এই শ্বেতপত্র দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনার জন্য এক যুগান্তকারী দলিল হয়ে থাকবে।