গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ৪৮ ঘণ্টায় শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত
ইসরায়েলের অবরুদ্ধ গাজায় হামলা: মানবিক বিপর্যয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গাজার ওপর ইসরায়েলের বিমান ও স্থল হামলা গত কয়েক দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, যার ফলে ফিলিস্তিনিরা অত্যন্ত দুর্বিসহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছে। দুই দিনে অন্তত ১২০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, এদের মধ্যে বেশিরভাগই সাধারণ নাগরিক, যাদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। হামলার তীব্রতা ও পরিসর গত মাসে নতুন করে শুরু হওয়া ইসরায়েলের স্থলাভিযান এবং বিমান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আরো বেড়েছে, যা মানবিক সংকটকে আরও গভীর করেছে।
১. বিমান হামলা ও স্থলাভিযান
গাজার বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে গাজার উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি বাহিনী ব্যাপক বোমাবর্ষণ ও স্থলাভিযান চালাচ্ছে। বিশেষ করে, গাজার জয়তুন এলাকায় একটি আবাসিক ভবনে হামলায় সাতজন নিহত হয়েছেন, এবং গাজার মধ্যাঞ্চলের নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে অবস্থিত আল-ফারুক মসজিদে বিমান হামলায় উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মসজিদটি ধ্বংসের জন্য বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল, যা ফিলিস্তিনি জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে গভীর আঘাত করেছে।
ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলা শুধুমাত্র আবাসিক এলাকা নয়, হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রকেও লক্ষ করে চালানো হয়েছে। গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে চিকিৎসক, নার্স এবং প্রশাসনিক কর্মীরা আহত হয়েছেন। হাসপাতালটির বৈদ্যুতিক জেনারেটর, প্রবেশপথ এবং অভ্যর্থনা এলাকা সরাসরি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। এটি ইসরায়েলি বাহিনীর বেসামরিক স্থান ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র লক্ষ্য করার একটি নতুন উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
২. মানবিক সংকট ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
ইসরায়েলের এই হামলার ফলে গাজা অঞ্চলের মানবিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং ত্রাণ সংগঠনগুলো গাজার উত্তরাঞ্চলে খাদ্য, চিকিৎসা এবং ত্রাণ সরবরাহের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত সপ্তাহে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে যে ইসরায়েলি হামলার ফলে গাজার উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে, যা এই অঞ্চলকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, গত মাসের হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় ৪৪ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, এবং ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে। এই বিশাল মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে, গাজার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব, বিদ্যুৎ সংকট এবং খাদ্য-জল সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এসব পরিস্থিতি ফিলিস্তিনিদের জন্য জীবনযাত্রা আরও কঠিন করে তুলেছে।
৩. ইসরায়েলের সামরিক প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই আক্রমণগুলোকে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করছে। তাদের দাবি, হামাস গাজা অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পুনরায় সংগঠিত হয়ে ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। তাই, তারা গাজার এই অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে হামাসকে প্রতিহত করতে চায়। তবে, ইসরায়েলি বাহিনীর এই বক্তব্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিশেষত, বেসামরিক জনগণের ওপর চালানো এই আক্রমণগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের মতো।
৪. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গাজার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া মিশ্রিত। কিছু পশ্চিমা দেশ, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু ইউরোপীয় দেশ ইসরায়েলের অধিকৃত অঞ্চল ও সুরক্ষা বিষয়ক অধিকাংশ পদক্ষেপ সমর্থন করছে। তবে, জাতিসংঘ, আইসিআরসি (International Committee of the Red Cross), এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের এই হামলা এবং গাজার বেসামরিক জনগণের ওপর তাদের আক্রমণের নিন্দা করেছে।
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জনগণের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সহানুভূতি এবং সহায়তার আহ্বান জানানো হয়েছে, কিন্তু ইসরায়েলি সরকারের অবস্থান দৃঢ় এবং তারা বলছে, হামাসকে প্রতিহত করা তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
৫. ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগ
ফিলিস্তিনিরা, বিশেষত গাজার বাসিন্দারা, দীর্ঘদিন ধরে অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছে এবং ইসরায়েলি হামলার মধ্যে তাদের জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। গাজার জনগণের জীবনে একদিকে যেমন যুদ্ধের ক্ষতি রয়েছে, তেমনি দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য, চিকিৎসা, পানি এবং নিরাপত্তাহীনতার অভাব তাদের মনের ওপর গভীর আঘাত করছে। এই পরিস্থিতি তাদের মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েলের গাজার ওপর চলমান হামলা মানবিক বিপর্যয়ের একটি জঘন্য উদাহরণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা, হাসপাতালসহ অতি জরুরি স্থাপনাগুলোর ওপর আক্রমণ এবং খাদ্য-যত্নের অভাব দেশটিতে এক অশান্তি ও ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত, এই সংকটের প্রতি নজর দেওয়া এবং সামরিক সহিংসতা বন্ধ করার চেষ্টা করা, যাতে গাজার জনগণ নিরাপত্তা এবং মানবিক সহায়তা পায়।