ট্রাম্পের মন্ত্রিসভায় ১৫ মনোনয়ন শেষ, কে কোন পদে
ট্রাম্পের নতুন প্রশাসন: বিশ্লেষণ ও প্রতিক্রিয়া
ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট, তাঁর প্রশাসনের জন্য যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন, তা অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌতূহল জাগানিয়া। একদিকে যেখানে ট্রাম্পের প্রশাসনকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মঞ্চে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে, সেখানে তাঁর মন্ত্রিসভার নির্বাচন সেই চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতি এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে। ট্রাম্প তাঁর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এই মন্ত্রিসভা সাজিয়েছেন, যার মধ্যে যেমন নবীন, তেমনি প্রবীণ ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই মন্ত্রিসভার মাধ্যমে ট্রাম্প কেমন ধরনের নীতি ও প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে চান, তার একটি পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
১. পররাষ্ট্রনীতি: মার্কো রুবিও
ট্রাম্প তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মার্কো রুবিওকে মনোনীত করেছেন, যিনি ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের সিনেটর এবং দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন ভূরাজনৈতিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে, চীন, ইরান, কিউবা এবং ইসরায়েল বিষয়ে তাঁর অবস্থান সুস্পষ্ট। রুবিও, যিনি কিউবান অভিবাসী পরিবারের সন্তান, ইসরায়েলের দৃঢ় সমর্থক এবং পুতিনের সমালোচক, তাঁর মাধ্যমে ট্রাম্পের প্রশাসন আরো শক্তিশালী, আনুষ্ঠানিক ও সংঘর্ষপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে পারে। বিশেষ করে, মধ্যপ্রাচ্য, চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের দিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনার সম্ভাবনা রয়েছে।
২. অর্থনীতি: স্কট ব্যাসেন্ট
ট্রাম্পের অর্থমন্ত্রী হিসেবে স্কট ব্যাসেন্টের নাম ঘোষণা অর্থনৈতিক নীতিতে আরো উদার ও ব্যবসাপ্রতিরোধী মনোভাবের দিকে ইঙ্গিত দেয়। ব্যাসেন্ট ওয়াল স্ট্রিটের সফল বিনিয়োগকারী এবং ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় একজন সক্রিয় সমর্থক। তাঁর মনোনয়ন, বিশেষ করে করনীতি, সরকারি ঋণ ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়া পদক্ষেপের সূচনা করতে পারে। এটি একদিকে ট্রাম্পের পূর্ববর্তী প্রশাসনের অর্থনৈতিক নীতির ধারাবাহিকতা, আবার অন্যদিকে একটি ব্যবসায়ী মনোভাবের দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন করে।
৩. শ্রমনীতি: লোরি শাভেজ-ডিরেমার
লোরি শাভেজ-ডিরেমারকে শ্রমমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করে ট্রাম্প শ্রম ও শ্রমিক অধিকারকে একটি বিশেষ জায়গায় দাঁড় করাতে চেয়েছেন। শাভেজ-ডিরেমারের কর্মজীবন ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর প্রতি তার আনুকূল্য, কর্মসংস্থান ও শ্রমিক অধিকার বিষয়ক নীতির পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে, তাঁর নিয়োগ শ্রমিক আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর জন্য এক ধরনের সতর্কতা সৃষ্টি করতে পারে, কারণ রিপাবলিকান দলের শ্রমনীতি সাধারণত ব্যবসায়ীদের পক্ষের হয়।
৪. বাণিজ্য: হওয়ার্ড লাটনিক
হোয়াইট হাউসের বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে ধনকুবের হওয়ার্ড লাটনিকের নাম ঘোষণা ট্রাম্পের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির আরও একটি নিশ্চিত প্রকাশ। লাটনিক, যিনি ওয়াল স্ট্রিটে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ। তাঁর মনোনয়ন ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বাণিজ্য নীতির প্রতি প্রবল সমর্থন প্রদর্শন করে। এখানে লক্ষ্য রাখা উচিত যে, লাটনিকের নিয়োগে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য সম্পর্ক ও আমদানি-রপ্তানি নীতি প্রভাবিত হতে পারে।
৫. কৃষি: ব্রুক রলিন্স
ট্রাম্প তাঁর দীর্ঘদিনের সহযোগী ব্রুক রলিন্সকে কৃষিমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছেন। রলিন্স একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সরকারী দফতরে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি ও কৃষকদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতিগত পরিবর্তন কৃষি খাতের প্রতি ট্রাম্পের দৃঢ় মনোভাব প্রকাশ করে।
৬. স্বাস্থ্যনীতি: রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র
স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়রের মনোনয়ন অনেক বিতর্কের জন্ম দিতে পারে। কেনেডি করোনার টিকার বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছেন এবং টিকার নিরাপত্তা নিয়ে বেশ কিছু অপ্রমাণিত দাবিও করেছেন। এটি ট্রাম্পের প্রশাসনের স্বাস্থ্যনীতির প্রতি একটি বড় পরীক্ষা হতে পারে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা খাতে আগ্রহী জনগণের কাছে।
৭. সামরিক নীতি: পিট হেগসেথ
ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে পিট হেগসেথের মনোনয়ন, যিনি ফক্স নিউজের উপস্থাপক এবং ন্যাশনাল গার্ডের সাবেক সদস্য, মার্কিন সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে নতুন দিকনির্দেশনা আনতে পারে। হেগসেথের মনোয়ন সামরিক সংস্কৃতির প্রতি তাঁর সহানুভূতির প্রতিফলন, যা সামরিক বাহিনীর মধ্যে একটি নতুন ধরণের মনোভাব এবং বাহিনীর সংস্কার উন্মোচন করতে পারে।
৮. পরিবহন: সোন ডাফি
ট্রাম্পের প্রশাসনে পরিবহনমন্ত্রী হিসেবে সোন ডাফির মনোনয়ন, যিনি এক সময় ফক্স নিউজের নিয়মিত উপস্থাপক ছিলেন, তার মাধ্যমে মার্কিন গণমাধ্যমের প্রভাব ও পরিবহন নীতির প্রতি রিপাবলিকান দলের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটতে পারে। ডাফি একাধারে গণমাধ্যম ও রাজনীতির অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পরিবহন খাতের উন্নতি করতে পারেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নতুন প্রশাসনে বৈচিত্র্যময়, অনেক ক্ষেত্রে বিতর্কিত, এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিয়েছেন। তাঁর প্রশাসন যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক মনোভাব, শক্তিশালী বিদেশনীতি এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থে জোর দিতে চায়, তা স্পষ্ট। এর মধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত যেমন মার্কিন জনগণের আস্থা অর্জন করতে চাইবে, তেমনি কিছু সিদ্ধান্ত দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করতে পারে।