রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ১০০০ দিন: লড়াই কি এখন ‘রোবট যুদ্ধে’ রূপ নিচ্ছে
ইউরি শেলমুক ইউক্রেনে সামরিক সরঞ্জাম তৈরির একটি প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা, যা ড্রোন সিগন্যাল জ্যামার তৈরির জন্য বিখ্যাত। শেলমুক জানান, তার প্রতিষ্ঠান প্রথমে ড্রোন সিগন্যাল জ্যামারের প্রতি খুব কম চাহিদা পেয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে ২,৫০০ ড্রোন সিগন্যাল জ্যামার তৈরি করছে এবং ক্রেতাদের জন্য অপেক্ষার সময় প্রায় ৬ সপ্তাহ হয়ে গেছে।
১. বদলে যাওয়া পরিস্থিতি:
২০২৩ সালের গ্রীষ্মের পর ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়লে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হয়। রুশ বাহিনী আকাশপথে অজ্ঞাত আকাশযান ব্যবহার করতে শুরু করে এবং ভূমিমাইন ও সেনা মোতায়েন বাড়ায়, যা ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য গুরুতর সমস্যা তৈরি করে। ইউরি শেলমুক মন্তব্য করেন, ড্রোন ছিল ‘গেম চেঞ্জার’। এর মাধ্যমে যুদ্ধের পরিবেশ এবং ইউক্রেনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায়।
২. ড্রোন প্রযুক্তি ও ইউক্রেনের সামরিক শিল্প:
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইউক্রেনের সামরিক উৎপাদন খাত দ্রুত প্রসারিত হতে থাকে। ইউক্রেনের ৮০০-এরও বেশি কোম্পানি নতুনভাবে গড়ে উঠেছে, যার মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ড্রোন প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করছে। এর মধ্যে ইউরি শেলমুকের প্রতিষ্ঠান “আনওয়েভ” অন্যতম, যা ড্রোনের সিগন্যাল ব্লক করতে সক্ষম। বর্তমানে ইউক্রেনের সামরিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা ক্রমাগত নতুন নতুন ড্রোন এবং ড্রোন বিধ্বংসী প্রযুক্তি তৈরি করছেন।
৩. ড্রোন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার:
এই বছর ইউক্রেন ও রাশিয়া মিলিয়ে প্রায় ১৫ লাখ ড্রোন তৈরি করবে, বেশিরভাগই ছোট আকারের ড্রোন যা দূর থেকে পরিচালনা করা যায় এবং শত্রুর লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করে ধ্বংস করতে সক্ষম। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ৩০টি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করেছে ড্রোন প্রতিরোধী প্রযুক্তি তৈরিতে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে পরিচালিত অস্ত্রের ব্যবহারও ক্রমেই বাড়ছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ও রোবট যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে।
৪. রোবট যুদ্ধ এবং প্রযুক্তির উত্থান:
বর্তমানে, ইউক্রেনের বাহিনী স্বয়ংক্রিয় বা মানববিহীন স্থলযান তৈরি করতে শুরু করেছে। এই যানগুলো রসদ সরবরাহ, আহতদের সরিয়ে আনা এবং দূরনিয়ন্ত্রিত মেশিনগান বহনে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর কর্নেল কলসাইন হেপহিয়েস্টাস জানান, তাদের ছয়টি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার শুরু হয়েছে, যা পূর্বে মানবচালিত মেশিনগানের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এছাড়া, ইউক্রেনের রাষ্ট্র-সমর্থিত প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্রেভওয়ান জানিয়েছে, তারা ১৬০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করেছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তৈরির কাজে।
৫. দক্ষ কর্মীর সংকট:
যদিও ইউক্রেনের সামরিক প্রযুক্তি এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্রুত উন্নতি করছে, তবে দক্ষ কর্মীর সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৪টি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তারা প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মী খুঁজে পাচ্ছে না, যার ফলে তাদের কার্যক্রমের পরিধি সংকুচিত হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৮৫% প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম ইউক্রেনের বাইরে সরানোর পরিকল্পনা করছে।
৬. ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি:
ইউক্রেনের কৌশলগত শিল্প মন্ত্রী হারম্যান স্মেতানিন বলেছেন, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আগামী বছরে বেশ কিছু নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হতে পারে, যা রোবট যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত হতে পারে। স্মেতানিনের মতে, এই প্রযুক্তি মানুষের জীবন রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ইউক্রেনের সামরিক শিল্পের এই দ্রুত প্রসার ও স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে, ড্রোন যুদ্ধ ও রোবট যুদ্ধ যেভাবে পাল্টাচ্ছে, তা পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলির জন্যও এক নতুন ধরণের যুদ্ধের ধারণা দিচ্ছে। তবে, এই প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন এবং কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে দক্ষ কর্মী এবং নতুন গবেষণা অপরিহার্য হবে।