আদানির চুক্তি পুনর্মূল্যায়নে কমিটি গঠনের নির্দেশ
বিষ্লেষণ: ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা
বাংলাদেশের হাইকোর্ট সম্প্রতি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা সকল চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। এই আদেশটি বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরী এর বেঞ্চ থেকে এসেছে। আদালতের এই নির্দেশনা এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে দেশের বিদ্যুৎ খাতে এর প্রভাব, একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এখন, বিষয়টির বিশ্লেষণ করা যাক:
১. চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা
হাইকোর্টের আদেশ অনুসারে, আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে, যার সদস্যদের মধ্যে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে। এই কমিটির কাজ হবে, আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তির বিভিন্ন দিক, যেমন দর-কষাকষি প্রক্রিয়া, অর্থনৈতিক ফলাফল এবং চুক্তির যথার্থতা যাচাই করা। মূলত, প্রশ্ন উঠেছে যে, এই চুক্তিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে সঠিক দর বা শর্ত ছিল কিনা এবং তা কি দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা ও বিদ্যুৎ খাতের ভবিষ্যৎ চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
২. ২০১৭ সালের চুক্তির প্রসঙ্গ
চুক্তি সম্পর্কিত মূল সমস্যা ২০১৭ সালে আদানি গ্রুপের সঙ্গে ২৫ বছরের মেয়াদী বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি। ওই সময়ে বাংলাদেশে আমদানি করা কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র কার্যক্রম শুরু হয়নি, তবে বিদ্যুৎ বিভাগের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। এই চুক্তি অনুসারে, আদানি গ্রুপের ঝাড়খণ্ডের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
এই চুক্তির বিষয়ে ব্যারিস্টার এম আব্দুল কাইয়ুম এর নেতৃত্বে একটি রিট দায়ের করা হয়েছিল, যেখানে দাবি করা হয়েছিল যে, চুক্তির শর্তাবলী এবং দর-কষাকষি নিয়ে যথেষ্ট স্বচ্ছতা ছিল না এবং এতে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ সঠিকভাবে রক্ষা করা হয়নি।
৩. কমিটির কার্যপরিধি এবং প্রতিবেদন
হাইকোর্ট কমিটিকে এক মাসের মধ্যে গঠন করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলেছেন। এই সময়সীমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি নিশ্চিত করবে যে, বিদ্যুৎ খাতে কোনো ধরনের দূরদর্শী এবং প্রভাবশালী সংস্কার আনা হবে কি না।
কমিটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তির নির্দেশনা দিয়েছে, যা চুক্তির বিশ্লেষণে বিশ্বস্ততা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদণ্ডে বিচার করার সুযোগ সৃষ্টি করবে। এর ফলে, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী চুক্তি মূল্যায়িত হবে এবং কোনো ধরনের আর্থিক বা আইনি গড়মিল থাকলে তা শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
৪. চুক্তি বাতিলের সম্ভাবনা
হাইকোর্ট রুল জারি করেছে যে, আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিল করার সম্ভাবনা বিবেচনা করতে হবে। এটি একটি বড় প্রশ্ন, কারণ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের জন্য আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে, আদালত মনে করছেন যে, যদি চুক্তির শর্তাবলী দেশের জন্য অনুকূল না হয়, তবে তা বাতিলের প্রশ্ন উঠতে পারে।
এর পাশাপাশি, চুক্তির নথি এবং দর-কষাকষি সম্পর্কিত তথ্য এক মাসের মধ্যে আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা চুক্তির স্বচ্ছতা এবং বৈধতার বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করবে।
৫. বিদ্যুৎ খাতের ভবিষ্যত প্রভাব
এই অনুসন্ধান এবং চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন প্রক্রিয়া, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত ও উন্নয়ন জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত দীর্ঘদিন ধরে সংকটের মধ্যে রয়েছে এবং শর্তাবলী সঠিক না হলে দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আরও অস্থিতিশীল হতে পারে। আদালতের এই পদক্ষেপের ফলে, ভবিষ্যতে এমন চুক্তি যাতে দেশের স্বার্থকে সমুন্নত রাখে, তা নিশ্চিত করা যাবে।
৬. সরকারের ভূমিকা
এই প্রক্রিয়ায় সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে দ্রুত এই অনুসন্ধান কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। সরকারের প্রতিশ্রুতি এবং সহযোগিতা ছাড়া আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি বেশ জটিল এবং এই চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন ও অনুসন্ধান প্রক্রিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। আদালত যদি চুক্তির অসঙ্গতি বা ভুল সিদ্ধান্ত খুঁজে পায়, তাহলে তা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নতির জন্য সহায়ক হতে পারে। তবে, এর সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং সরকারের সহযোগিতা, এই প্রক্রিয়ার সফলতা নির্ভর করবে।