December 22, 2024
ধান-চাল সংগ্রহ বাড়াচ্ছে সরকার

ধান-চাল সংগ্রহ বাড়াচ্ছে সরকার

নভে ১৮, ২০২৪

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও চালের মজুত পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ও উদ্বেগের বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে বন্যার কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদনে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তাতে সরকারের তৎকালীন কার্যক্রম ও পরিকল্পনা স্পষ্ট হয়েছে। নিচে এই পরিস্থিতির বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো:

১. বন্যার প্রভাব এবং উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা:

  • বন্যার প্রভাব: দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার কারণে ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে ফেনী, নোয়াখালী এবং অন্যান্য এলাকা উল্লেখযোগ্য। বন্যায় আবাদি জমি প্লাবিত হওয়ার ফলে ধানসহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমে যেতে পারে।
  • উৎপাদন ঘাটতি: কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রথম পর্যায়ের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১০ লাখ টন ধান উৎপাদনে ঘাটতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তবে পরবর্তীতে এটি কমিয়ে আনুমানিক ৬-৭ লাখ টনে সংশোধিত হয়েছে। এই ঘাটতি পূরণে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২. সরকারের পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা:

  • ধান ও চাল সংগ্রহ: সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষকদের কাছ থেকে বাড়তি ধান ও চাল সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। বোরো মৌসুমে গত বছর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাল সংগ্রহ করা হয়েছে, এবং আমন মৌসুমেও সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। বোরো মৌসুমে অতিরিক্ত ৩০,৩৫৯ টন সিদ্ধ চাল ও ২৪,৭৮৭ টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।
  • চাল আমদানি: দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে সরকার চাল আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বছর সাড়ে ১০ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্য রয়েছে, যার মধ্যে ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ চাল আমদানি করার পরিকল্পনা। এই আমদানি ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও ভারত থেকে সম্পন্ন হবে।
  • ডলার সাশ্রয়: বিদেশি মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্য সরকার স্থানীয় উৎস থেকে বাড়তি চাল সংগ্রহ করছে, যার ফলে খাদ্যশস্যের বাজারে স্থিতিশীলতা আনার আশা রয়েছে।

৩. খাদ্য মজুত পরিস্থিতি:

  • মজুত পরিস্থিতি: ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের খাদ্যশস্য মজুত প্রায় ১২ লাখ ৫৫ হাজার টন ছিল, যার মধ্যে ৮ লাখ ২৩ হাজার টন চাল এবং ৬৬৮ টন ধান অন্তর্ভুক্ত। তবে, সরকারের হিসেবে এ মজুত পর্যাপ্ত নয়, তাই চাল আমদানির পাশাপাশি খাদ্য মজুত বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
  • আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহ: যদিও আমদানি শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করা হয়েছে, তবে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা চাল আমদানিতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই অনাগ্রহের কারণে বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়নি।

৪. চালের দাম ও বাজার পরিস্থিতি:

  • চালের দাম বৃদ্ধি: চালের দাম বর্তমানে বেড়েছে, বিশেষ করে পাইজাম, মাঝারি মানের চাল এবং মোটা চালের দাম আগের তুলনায় বেশ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি আমন মৌসুম শুরু হলেও বাজারে দাম বাড়ছে, যা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
  • সরবরাহ সংকট: চালের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সরবরাহ সংকট অন্যতম কারণ। যদিও সরকার চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তবে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি না হলে দাম নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে উঠবে।

৫. সরকারের উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:

  • খাদ্য মজুত ও নিরাপত্তা: সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, চলতি অর্থবছরের মধ্যে খাদ্য মজুত পর্যাপ্ত রাখতে এবং দাম স্থিতিশীল রাখতে ব্যবস্থা গ্রহণ।
  • সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়: সরকার বেসরকারি খাতকে চাল আমদানির জন্য উৎসাহিত করতে চেষ্টা করছে, তবে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অদূরদর্শিতা বা অনাগ্রহের কারণে সরকারকেই বাজার নিয়ন্ত্রণে বেশি মনোযোগ দিতে হচ্ছে।
  • দাম নিয়ন্ত্রণ: আমদানির পরও বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের কঠোর মনিটরিং এবং সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, যাতে দাম দ্রুত না বাড়ে এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে গ্রহণযোগ্য থাকে।

৬. চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা:

  • চ্যালেঞ্জ: মূল চ্যালেঞ্জ হল, বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা আমদানিতে আগ্রহী না হওয়া এবং বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি। এছাড়া বন্যার কারণে উৎপাদন ঘাটতি ও মজুতের অপ্রতুলতা থেকেও সংকট বাড়তে পারে।
  • সম্ভাবনা: তবে, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে বাড়তি চাল সংগ্রহ এবং আন্তর্জাতিকভাবে চাল আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতে পারে। বিশেষ করে সরকারি উদ্যোগ ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে বাজার পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হতে পারে।

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও চালের বাজার পরিস্থিতি বর্তমানে একটি সংকটময় মুহূর্তে রয়েছে। বন্যার কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরকার বাড়তি চাল সংগ্রহ এবং আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে, তবে বেসরকারি খাতের অনাগ্রহ ও বাজারের অনিশ্চয়তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও, যদি ব্যবসায়ীরা আমদানিতে আগ্রহ না দেখায়, তবে চালের দাম স্থিতিশীল রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

Leave a Reply