হিজবুল্লাহর মুখপাত্রকে হত্যা করলো ইসরায়েল
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় হিজবুল্লাহর মুখপাত্র মোহাম্মদ আফিফের নিহত হওয়া এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সাম্প্রতিক ঘটনা বিশ্লেষণ করলে, এটি কিছু বড় কৌশলগত, রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক নির্দেশ করে। আসুন, এই হামলার প্রেক্ষাপট ও তার সম্ভাব্য ফলাফলগুলো বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করি:
ইসরায়েলি হামলা স্পষ্টভাবে হিজবুল্লাহ এবং তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এক কৌশলগত আক্রমণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। আফিফের হত্যার মাধ্যমে ইসরায়েল হয়তো হিজবুল্লাহর নেতৃত্বের সক্ষমতা এবং তার মিডিয়া শাখার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী মূলত হিজবুল্লাহর সামরিক শাখা ছাড়াও তাদের প্রশাসনিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্তরের কর্মকর্তা ও মিডিয়া কর্মীদের লক্ষ্য করছে, যা তাদের সামরিক সক্ষমতা ছাড়াও সংগঠনটির জনপ্রিয়তাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায়।
আফিফের ভূমিকা ছিল হিজবুল্লাহর শীর্ষ মিডিয়া সম্পর্ক অফিসার হিসেবে এবং তার মৃত্যুর মাধ্যমে ইসরায়েল সম্ভবত হিজবুল্লাহর সাংগঠনিক গঠন এবং জনগণের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছানোর ক্ষমতাকে দুর্বল করতে চাচ্ছে। আফিফ আগে আল-মানার টেলিভিশন পরিচালনা করতেন, যা হিজবুল্লাহর মূল মিডিয়া আঙিনা হিসেবে কাজ করত। ইসরায়েলি হামলা সম্ভবত এই ধারাবাহিক কৌশলের অংশ, যেখানে সংগঠনটির প্রচারণা ও নেতৃত্বের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আফিফের মৃত্যুর পর হিজবুল্লাহ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা গুরুত্বপূর্ণ। গত মাসে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ-এর ওপর হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল, যা ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের অংশ হতে পারে। সামরিক বিশ্লেষক এলিজাহ ম্যাগনিয়ার এর উপর মন্তব্য করেছেন যে, আফিফের হত্যাকাণ্ড হিজবুল্লাহর প্রতিক্রিয়া সমন্বয়ের ক্ষমতা কমিয়ে দেবে এবং তাদের সামরিক বিবরণ মোকাবেলা করার সামর্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
হিজবুল্লাহ ইতিমধ্যেই ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে এবং তার শীর্ষ নেতাদের উপর আক্রমণ চালানো হলে, তারা কৌশলগতভাবে আরও শক্তিশালী প্রতিরোধ গঠন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আফিফের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হারানোর পর, হিজবুল্লাহ আরও প্রচারমূলকভাবে তাদের প্রতিরোধের মন্ত্র জোরদার করতে পারে।
লেবাননের বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলি ইসরায়েলি হামলায় অনেকটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। এখানে বাস্তুচ্যুত লেবানিজদের আশ্রয় নেওয়ার খবর রয়েছে, এবং একে কেন্দ্র করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে এলাকা খালি করার নির্দেশ না দিলেও, এর ফলে মানবিক সংকট আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো এলাকাকে খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়নি, তবে ইসরায়েল যে পুরোপুরি হিজবুল্লাহকে দমন করতে চায় তারই অংশ হিসেবে, তারা অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ফ্রন্টে হিজবুল্লাহর শক্তি কমানোর চেষ্টা করছে।
২০১৯ সালের শেষের দিকে সীমান্তে গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর, ইসরায়েল বেশ কিছু আক্রমণাত্মক কার্যক্রম চালিয়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষে ইসরায়েল নাটকীয়ভাবে হামলা জোরদার করে, এবং ১১ নভেম্বর আফিফের হত্যার ঘটনা আসলে এরই ধারাবাহিকতা। ইসরায়েলি সেনারা লেবাননে হিজবুল্লাহর যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং সেনা সমাবেশের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে এবং এতে তাদের সমর্থিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হামলা অব্যাহত রেখেছে।
হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলি সংঘাতের এই পর্বটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বড় আকারে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। লেবাননে ইসরায়েলি আক্রমণের প্রেক্ষিতে ইরান এবং অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলি হিজবুল্লাহকে সমর্থন প্রদান করতে পারে, যা পুরো অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। বিশেষত, ইরান ও ইসরায়েল এর মধ্যে যুদ্ধে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আফিফের মৃত্যু সেই সংঘর্ষের আরেকটি কিস্তি হিসেবে গণ্য হতে পারে।
আফিফের মৃত্যুর পাশাপাশি, ইসরায়েলি হামলার কারণে লেবাননের মানবিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠতে পারে। বিশেষত, বৈরুত ও আশপাশের অঞ্চলে যেসব সাধারণ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা তীব্র হবে। তবে, ইসরায়েলি হামলার মাধ্যমে হিজবুল্লাহকে একাধিক ফ্রন্টে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হলেও, এটি আরও বড় আঞ্চলিক সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
ইসরায়েলি হামলায় আফিফের মৃত্যু হিজবুল্লাহর সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে লক্ষ্য করে একটি বড় আক্রমণ। ইসরায়েল যে হিজবুল্লাহকে সম্পূর্ণ দমন করার চেষ্টা করছে, তা স্পষ্টভাবে এই হত্যাকাণ্ড এবং তার পূর্ববর্তী হামলার মাধ্যমে প্রতীয়মান। তবে, এই ধরনের হামলাগুলি বৃহত্তর সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, এবং মানবিক পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে চলে যেতে পারে, যা পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।