মহাপ্লাবনে হারিয়ে যাওয়া ২ শহরের উপাখ্যান
হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবন বিষয়টি পৃথিবীর একাধিক ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহিনীতে উল্লেখিত হয়েছে, এবং এটি অনেক গবেষক ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্য একটি গভীর রহস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের অ্যালবার্ট লিনের “লস্ট সিটিজ উইদ অ্যালবার্ট লিন” সিরিজের একটি অধ্যায়, ‘অরিজিনস অব দ্যা গ্রেট ফ্লাড’, এই মহাপ্লাবন সম্পর্কিত কিছু আকর্ষণীয় তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপন করেছে। সিরিজটি বুলগেরিয়া এবং পেরুতে সংঘটিত দুটি পৃথক মহাপ্লাবনের ঘটনা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে।
১. বুলগেরিয়ার মৃত সাগর (Dead Sea) এবং মহাপ্লাবন:
বুলগেরিয়ার মৃত সাগর বা ডেড সি, যদিও জলাশয় হিসেবে পরিচিত, এটি আসলে একটি বিস্তৃত জমির মধ্যে আটকে থাকা বিশাল জলাশয়। এই সাগরকে কেন্দ্র করে বহু গবেষণা হয়েছে, এবং অনেকের বিশ্বাস এটি হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের স্রষ্টা হতে পারে।
- বুলগেরিয়ার প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. ক্রিস্টো স্মোলানফ মৃত সাগরের নিচে হারানো একটি সভ্যতার প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন। তারা সেখানে কসমিক গোল্ড নামক প্রায় ৭০০০ বছরের পুরনো সোনার দ্রব্যাবলি আবিষ্কার করেন। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম সোনা হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং প্রায় ১৩ পাউন্ড সোনা পাওয়া যায়। এ আবিষ্কারটি সাগরের উত্থান-পতন এবং প্লাবন সম্পর্কিত রহস্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে।
- ইতিহাসবিদরা বিশ্বাস করেন, বরফ যুগের পর অনেক বরফ গলে গিয়ে ভূমধ্যসাগর উপচে পড়ে এবং মৃত সাগরের আয়তন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যা একটি বৃহত্তর জলবায়ু পরিবর্তন সৃষ্টি করে এবং সম্ভবত সেই সময় মহাপ্লাবন সম্পর্কিত ধারণাগুলি গড়ে ওঠে।
২. পেরুর মহাপ্লাবন এবং চিমু সভ্যতা:
পরবর্তী পর্বে, অ্যালবার্ট লিন পেরুর দিকে চলে যান এবং চিমু সভ্যতার কেন্দ্রস্থল, ত্রুজিলো শহর পরিদর্শন করেন। এখানে তিনি একটি ভয়ংকর মহাপ্লাবনের কাহিনী সম্পর্কে জানেন যা হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের মতো একই ধরনের ধারণাকে সমর্থন করে।
- চিমু সভ্যতা সম্পর্কে পৌরাণিক কাহিনীতে উল্লেখ রয়েছে যে, একটি লামা ভয়ঙ্কর এক মহাপ্লাবন নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল। ওই লামার স্বপ্নের ভিত্তিতে, তার মালিকসহ কিছু বিশেষ মানুষ এবং পশু জীবিত থাকতে পেরেছিল। এই ধরনের কাহিনীও হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের কাহিনীর সঙ্গে মিল রয়েছে, যেখানে একমাত্র নূহ (আ.) ও তার অনুসারীরা বেঁচে ছিল।
- ফেরেন কাস্টিলো, ত্রুজিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ, জানান যে, ১৪৫০ সালে চিমু সভ্যতায় একটি ভয়ংকর বলিদান ঘটেছিল, যেখানে ১৪০টি শিশু এবং ২০০টি লামাকে দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছিল। মন্দিরে খননকাজের সময়, ৭৪টি লামার দেহাবশেষ এবং ৪০টি শিশুর হাড় পাওয়া যায়। এসব শিশুদের বয়স ছিল ৫ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে, এবং অনেকের পাঁজর ভাঙা ছিল, যা নির্দেশ করে যে, তাদের হৃৎপিণ্ড খুলে নেওয়া হয়েছিল। এই বলিদানটি বিশেষ করে বন্যা ও বৃষ্টি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে ছিল, যা মহাপ্লাবনের পূর্বাভাস হিসেবে দেখা যেতে পারে।
৩. মহাপ্লাবন এবং মানব ইতিহাস:
এই দুটি মহাপ্লাবন কাহিনী—বুলগেরিয়ার মৃত সাগর এবং পেরুর চিমু সভ্যতার দুর্যোগ—হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। পুরাণ ও ধর্মীয় কাহিনীগুলো সাধারণত সমাজের ভয় ও দুর্যোগের অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে বৃহত্তম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় সৃষ্ট হয়।
- বুলগেরিয়ার সাগরের ঘটনা: মৃত সাগরের প্রাচীন জলাশয়ের বিস্তার একটি বৃহত্তর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণ হতে পারে, যা অতীতে এক বিশাল প্লাবনের সৃষ্টি করেছে। এই প্লাবনই সম্ভবত বিভিন্ন সংস্কৃতিতে মহাপ্লাবনের কাহিনী হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।
- পেরুর চিমু সভ্যতার বন্যা: চিমু সভ্যতার খোঁজ পাওয়া এমন এক মহাপ্লাবনের ধারণাকে বাঁচিয়ে রাখে যেখানে বিশেষ কিছু মানুষ ও প্রাণী বেঁচে থাকতে পেরেছিল। এই কাহিনীও মহাপ্লাবন সম্পর্কিত ধর্মীয় কাহিনীর সঙ্গে মেলে, যেখানে মহাপ্লাবনের সময় নির্বাচিত কিছু মানুষ বেঁচে গিয়েছিল।
হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনকে কেন্দ্র করে প্রচলিত নানা কাহিনী পৃথিবীজুড়ে মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে রয়েছে। অ্যালবার্ট লিন এবং অন্যান্য গবেষকরা যে মহাপ্লাবনের বাস্তব প্রমাণ খুঁজে বের করেছেন তা একদিকে মানব ইতিহাসের রহস্য উদঘাটনের জন্য সাহায্য করছে, অন্যদিকে এই মহাপ্লাবন কাহিনীগুলির প্রচলন ও বিস্তার কিভাবে মানবজাতির অভিজ্ঞতার প্রতিফলন, তা সম্পর্কে নতুন চিন্তা উত্থাপন করছে।