ফ্যাসিবাদের পতন হলেও এখনো স্বস্তির সুযোগ নেই: নুরুল হক
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের বক্তব্য থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসে, যা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে গভীর চিন্তা এবং উত্তরণের প্রস্তাবনা প্রদান করে। তার বক্তব্যের বিশ্লেষণে কয়েকটি মূল বিষয় পরিস্কারভাবে উঠে আসে:
১. বিভক্তি এবং ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন
নুরুল হক নুর উল্লেখ করেছেন, ৫ আগস্টের আগে যে ঐক্য ছাত্র-জনতার মধ্যে গড়ে উঠেছিল, তা এখন ফাটল ধরেছে। তার মতে, অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হওয়ায়, ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসনের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, কারণ কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে যখন ঐক্যবদ্ধ শক্তি কমে যায়, তখন সেই আন্দোলন বা বিপ্লবের অর্জনগুলো স্থায়ী হতে পারে না। বিভাজন সাধারণত আন্দোলনের শক্তি কমিয়ে দেয় এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পুনরুত্থান ঘটাতে পারে।
বিশ্লেষণ:
- বিভক্তির কারণ: সাধারণত আন্দোলনের মধ্যকার ঐক্য এমন এক মুহূর্তে ভেঙে যায় যখন বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য এবং বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য তৈরি হয়। এই বিভাজন হয়তো নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব বা আদর্শগত পার্থক্যের কারণে ঘটেছে।
- ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন: যখন অভ্যুত্থানের বিভিন্ন অংশীদার বিভক্ত হয়, তখন ফ্যাসিবাদী শক্তির ফিরে আসার পথ তৈরি হয়। ঐক্যহীনতা ক্ষমতাসীনদের আরও শক্তিশালী হতে সাহায্য করে, কারণ তারা বিভক্ত শক্তির মুখোমুখি না হয়ে একক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
২. রাষ্ট্র সংস্কার এবং সমাজ সংস্কারের প্রয়োজন
নুরুল হক নুরের মতে, রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি সমাজ ও রাজনীতির সংস্কারও জরুরি। তিনি বিশেষভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দানবীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা বলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন, দ্ব chambersবিশিষ্ট সংসদ এবং চার বছর মেয়াদী সংসদের প্রস্তাবনা দিয়েছেন।
বিশ্লেষণ:
- রাজনৈতিক সংস্কার: তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, তিনি বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রীকৃত এবং স্বেচ্ছাচারী গঠন নিয়ে অসন্তুষ্ট। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা ও দ্ব chambersবিশিষ্ট সংসদ প্রস্তাব করে তিনি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া চালু করতে চাইছেন। এর মাধ্যমে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে শক্তি-বন্টন হবে এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতার একক কেন্দ্রিক ধারণা পরিবর্তিত হবে।
- রাজনীতির সংস্কার: শুধুমাত্র রাষ্ট্রের সংস্কার নয়, নুরুল হক নুর সমাজের সংস্কার এবং রাজনীতির সংস্কারের উপরও গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে যাতে জনগণের প্রকৃত দাবি এবং প্রয়োজন প্রতিফলিত হয়।
৩. গণ–আন্দোলনে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত জনগণের ভূমিকা
নুরুল হক নুর মন্তব্য করেছেন যে, খেটে খাওয়া মানুষের কাছে রাষ্ট্র সংস্কারের ধারণা পরিষ্কার নয়, তারা মূলত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমানোর দাবি জানায়। তিনি ৫-৬ কোটি নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের কথাও উল্লেখ করেছেন, যারা গণ-আন্দোলনের মূল ভিত্তি। তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করা, বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা, এবং সরকারের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক উন্নত করা প্রয়োজন।
বিশ্লেষণ:
- জনগণের বাস্তব দাবি: নুরুল হক নুর অত্যন্ত বাস্তব এবং জরুরি দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। গণ-আন্দোলন যেহেতু সাধারণ মানুষের মধ্যে জন্ম নেয়, সেহেতু তাদের বাস্তব, দৈনন্দিন সমস্যাগুলির প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। শুধু বড় রাজনৈতিক সংস্কারের কথা না বলে, সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা উচিত।
- সরকারের প্রতি প্রত্যাশা: জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং সহযোগিতা জরুরি। সরকারের উচিত জনগণের সমস্যাগুলি বুঝে তাদের সমাধান করতে চেষ্টা করা, যাতে মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থা ও সমর্থন বজায় থাকে।
৪. ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য ও বিভেদ
গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে এবং বিভেদ সৃষ্টি করতে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, “গণ-অভ্যুত্থান বেহাত হতে দেওয়া যাবে না,” এবং এর অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের অপরাধীদের বিচারের জন্য সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু নিরীহ আওয়ামী লীগ সদস্যদের প্রতি সমবেদনা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে বলেছেন।
বিশ্লেষণ:
- ঐক্য ও বিভেদ: এই মন্তব্যে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। যখন অভ্যুত্থান বা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য একই থাকে, তখন বিভেদ সেই আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়। ঐক্য রক্ষার মাধ্যমে তারা বৃহত্তর উদ্দেশ্য অর্জনে সক্ষম হতে পারে।
- নিরীহদের প্রতি সহানুভূতি: রাশেদ খানের মন্তব্যে যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে, তা দেখাচ্ছে যে, আন্দোলনের অংশীদারদের মধ্যে বিভাজন ও সহিংসতার পথকে বন্ধ রাখা অত্যন্ত জরুরি। আন্দোলন কোনো পক্ষকে নিঃশেষ করার লক্ষ্যে নয়, বরং একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পরিচালিত হতে হবে।
এই আলোচনা সভা এবং বক্তৃতাগুলির মধ্যে যে মূল বার্তাগুলি উঠে এসেছে, তা হলো রাজনৈতিক ঐক্য ও সংস্কারের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া, জনগণের বাস্তব সমস্যাগুলির সমাধানে মনোযোগ দেওয়া, এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। নুরুল হক নুর এবং রাশেদ খান সমঝোতা, সহযোগিতা এবং রাজনৈতিক বিভেদগুলো দূর করতে একটি বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন। এছাড়া, রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি জনগণের মৌলিক জীবনমান উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক স্বস্তি ফিরিয়ে আনার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।