বুকার পুরস্কার জিতলেন ব্রিটিশ লেখক সামান্থা হার্ভে
২০২৪ সালের বুকার পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে সামান্থা হার্ভে-এর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর “অরবিটাল” বইটি এই prestigious পুরস্কারটি অর্জন করেছে। এটি একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কাজ, যা আন্তর্জাতিক মহাকাশকেন্দ্রে ছয় মহাকাশচারীর একদিনের জীবনের গল্প নিয়ে লেখা হয়েছে। এই বইটি পৃথিবী ও মহাকাশের মধ্যে সীমানা এবং টাইম জোনের অভ্যন্তরীণ জটিলতাগুলির মধ্য দিয়ে মানবিক অভিজ্ঞতার বিস্তৃত অনুসন্ধান করছে। চলুন, এই পুরস্কার এবং বইটির বিশ্লেষণ করি।
১. বইয়ের বিষয়বস্তু: “অরবিটাল”
“অরবিটাল” বইটি মহাকাশযাত্রার এক অপ্রচলিত দৃষ্টিকোণকে ফুটিয়ে তুলেছে, যেখানে ছয় মহাকাশচারী — দুজন পুরুষ এবং চারজন নারী — আন্তর্জাতিক মহাকাশকেন্দ্রে একদিন কাটানোর মাধ্যমে পৃথিবী ও মহাকাশের সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। এদের মধ্যে প্রতিটি চরিত্রের নিজের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিকোণ রয়েছে, যা বইটির গভীরতা এবং জটিলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বিচারক প্যানেলের chairperson, এডমুন্ড ডে ওয়াল, বইটিকে “ক্ষতবিক্ষত পৃথিবীর গল্প” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, বইটি মহাকাশযাত্রার বিষয়বস্তুকে একটি অত্যন্ত মানবিক ও অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ আঙ্গিকে দেখায়, যেখানে পৃথিবী এবং মহাকাশের মধ্যে থাকা সীমানা ও টাইম জোনের জটিলতাকে গভীরভাবে অনুভব করা যায়।
বইটি এমন এক পৃথিবীকে তুলে ধরে, যেখানে প্রযুক্তি ও মানবিক অনুভূতির অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটে, এবং মহাকাশের মতো অজানা স্থানে অবস্থান করেও একে অপরের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার সংগ্রাম নিরন্তর থাকে। এটি শুধুমাত্র মহাকাশের পদার্থবিজ্ঞান বা প্রযুক্তি নয়, বরং মানুষের অন্তর্দৃষ্টি, অনুভূতি, এবং পৃথিবীকে ঘিরে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও গভীর পর্যালোচনা করে।
২. বুকার পুরস্কারের মূল্যায়ন
বুকার পুরস্কার আন্তর্জাতিক সাহিত্যের একটি অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। এর মাধ্যমে লেখকের কাজের সৃজনশীলতা, ভাষার বৈশিষ্ট্য এবং সমাজ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন যাচাই করা হয়। হার্ভে-এর “অরবিটাল” তার সৃজনশীলতা, ভাষার শৈলী এবং গল্পের গভীরতার কারণে বিচারকদের প্রশংসা অর্জন করেছে। ডে ওয়াল বলেছেন, এই বইয়ের প্রতিটি চরিত্রই বিষয়বস্তু, অথচ কেউই বিষয়বস্তু নয় — এর মাধ্যমে হার্ভে মানবিকতা, প্রযুক্তি, এবং মহাকাশের মাঝে আমাদের সম্পর্কের একটি সংবেদনশীল প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন।
“অরবিটাল” বইটি বইয়ের গঠন এবং চরিত্রের সূক্ষ্মতা সহ বেশ কিছু কারণে বিশেষ। প্রথমত, এটি মহাকাশকে কেন্দ্র করে লেখা প্রথম বই যা বুকার পুরস্কার পেয়েছে, যা সাহিত্যবিশ্বে এটি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত, এর পৃষ্ঠা সংখ্যা অত্যন্ত কম — মাত্র ১৩৬ পৃষ্ঠা — অথচ এই ছোট আকারের মধ্যে বিশাল মানবিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি বুকার পুরস্কারের ইতিহাসে দ্বিতীয় সংক্ষিপ্ততম বই, যা পুরস্কৃত হয়েছে।
৩. বইটি লেখার প্রেক্ষাপট: কোভিড-১৯ মহামারি
একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সামান্থা হার্ভে কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন সময়ে এই বইটির বেশিরভাগ অংশ লিখেছিলেন। লকডাউনের সময় ঘরবন্দী অবস্থায় তিনি মহাকাশের অন্তরঙ্গ জগৎ এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য গভীর চিন্তা-ভাবনা করেছেন। মহামারির এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে তিনি “অরবিটাল” বইটি লিখে তার সৃজনশীলতা ও শিল্পকলার নতুন এক দৃষ্টিকোণ সৃষ্টি করেছেন, যা বইটির মধ্যে একটি ধরনের অতিপ্রাকৃত শক্তি যোগ করেছে।
এছাড়া, হার্ভে তাঁর পুরস্কারের ৫০ হাজার পাউন্ড অর্থ অন্যদের জন্য উৎসর্গ করেছেন, বিশেষত তাঁদের জন্য যারা বিশ্ব শান্তি এবং অন্য মানুষের মর্যাদা রক্ষায় কাজ করছেন। এটা হার্ভের মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন এবং তাঁর সৃজনশীলতা ও নৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে।
৪. সামাজিক এবং সাহিত্যিক প্রেক্ষাপট
হার্ভে তার লেখার মাধ্যমে গভীর সামাজিক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছেন, যা সাহিত্যের সাথে বৈজ্ঞানিক ন্যারেটিভ একত্রিত করার একটি চমৎকার উদাহরণ। বইটি শুধুমাত্র মহাকাশ এবং মানবিক সম্পর্কের উপস্থাপন নয়, বরং এটি বৈজ্ঞানিক ধারণা এবং মানবিক অনুভূতিকে একসাথে মিলিয়ে একটি নতুন ধারার সাহিত্য তৈরি করেছে। এই দৃষ্টিকোণটি যে আগামী দিনের সাহিত্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা এই পুরস্কারের মাধ্যমে আরও প্রমাণিত হলো।
৫. বুকার পুরস্কারের প্রতিযোগিতা
২০২৪ সালের বুকার পুরস্কারের জন্য অন্যান্য মনোনীত বইগুলোর মধ্যে ছিলেন র্যাচেল কুশনার (অব “ক্রিয়েশন লেক” বইয়ের জন্য) এবং অ্যান মাইকেলস (অব “হেল্ড” বইয়ের জন্য)। যদিও তারা সবই অত্যন্ত প্রশংসিত কাজ, তবে হার্ভে তার “অরবিটাল” বইটির মাধ্যমে বিচারের মূল্যায়নে এগিয়ে গেছেন। এতে পরিষ্কার হয় যে, মানবিকতা এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ নিয়ে সাহিত্যের গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলেছে।
২০২৪ সালের বুকার পুরস্কার-এর জন্য সামান্থা হার্ভে-এর “অরবিটাল” বইটি জয়লাভ করেছে, যা সাহিত্যিক গুণ, সৃজনশীলতা এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের একটি মিশ্রণ হিসেবে উত্থান ঘটিয়েছে। মহাকাশের রহস্য এবং পৃথিবীসংক্রান্ত মানবিক সম্পর্কের নিবিড় অনুসন্ধান এই বইটিকে সাহিত্যের নতুন এক স্তরে নিয়ে গেছে। হার্ভে তার লেখার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে সাহিত্যের মাধ্যমে মানবিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা সম্ভব, এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের সাহিত্যের আরও বড় ভূমিকা থাকতে পারে।