ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনী রোডম্যাপ চায় বিএনপি
বিএনপির নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি ও এর বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক আলোচনাগুলি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গত সোমবার অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক ও এর পরবর্তী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা, দলটির নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়টি, এবং রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। চলুন, এই বিষয়টির বিশ্লেষণ করি:
১. নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবি
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের যুক্তি, নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী সরকার কিংবা অবৈধ শাসনব্যবস্থা প্রতিহত করা সম্ভব হবে, এবং এরই ভিত্তিতে তারা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করতে চায়। বিএনপি মনে করছে, নির্বাচনকালীন রোডম্যাপ নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার শঙ্কা থাকবে, যা দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি করতে পারে।
বিএনপি নেতাদের মতে, একদিকে নির্বাচন এবং অন্যদিকে রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার—এই দুটি বিষয় সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলা উচিত, যাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা নিশ্চিত করা যায়। দলের শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, সরকারের কাছে সময়সীমার মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপের ঘোষণা না আসলে, রাজপথে আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা করতে হবে। দলটি জানিয়ে দিয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা না হলে, মার্চ-এপ্রিল ২০২৫ মধ্যে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন দাবি নিয়ে সোচ্চার আন্দোলন শুরু করবে তারা।
২. মাঠে নামার প্রস্তুতি ও বিভাগীয় সমাবেশ
বিএনপি শিগগিরই দেশের ১০টি সাংগঠনিক বিভাগের মধ্যে বড় সমাবেশ আয়োজনের পরিকল্পনা করছে। এর মাধ্যমে দলের ভিতর শক্তি জোগানো, এবং জনসাধারণের মধ্যে নির্বাচনকালীন দাবি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হবে। সমমনা দলগুলোকে একত্রিত করে শক্তিশালী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে চাইছে বিএনপি, কিন্তু তা অন্যায্য বা চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য নেই। তারা চায়, আন্দোলন থাকবে নিয়মতান্ত্রিক এবং আইনগত ভাবে গ্রহণযোগ্য, যাতে চাপ সৃষ্টি করা যায়।
এছাড়া, বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে একটি মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিগত কয়েক বছরে এই সম্পর্কের মধ্যে কিছু চ্যালেঞ্জ এবং মতপার্থক্য সৃষ্টি হলেও, এখন বিএনপি মনে করছে জামায়াতের সঙ্গেও একত্রিতভাবে আন্দোলন চালানো প্রয়োজন। বিশেষ করে, জাতীয় ঐকমত্য ও নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গেও ঐক্য গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ।
৩. সরকারের ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট
বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের নির্বাচনী রোডম্যাপের বিষয়ে অব্যক্ততা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তারা মনে করছে, সরকারের পক্ষ থেকে রোডম্যাপ না ঘোষণা করলে রাজনৈতিক সংকট বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে, সরকারকে দাবি করা হয়েছে, যাতে বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে একযোগে একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরি করা হয়। সরকারের দৃষ্টি যেন নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সমন্বয়েই কেন্দ্রীভূত থাকে—এটাই বিএনপির প্রত্যাশা।
এছাড়া, সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নতুন নিয়োগ নিয়েও বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগের মাধ্যমে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস পাবে। বিএনপির মতে, কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি বা পদে নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষে যুক্তির শূন্যতা তৈরি হতে পারে। তারা সরকারের কাছে এই ধরনের পদক্ষেপ এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
৪. বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক কৌশল
বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক প্রাচীন রাজনৈতিক মিত্রতার উপর ভিত্তি করে হলেও, পরবর্তী সময়ে এই সম্পর্কের মধ্যে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বরের বিভাগীয় সমাবেশের আগে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয়ার পরও, বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছে। মুখোমুখি আন্দোলন ও সরকারের বিরুদ্ধে যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, তবে জামায়াতের কিছু সিদ্ধান্ত এবং কর্মসূচি দলের পক্ষে খুব সুবিধাজনক নয়।
এখন বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নির্বাচনের প্রশ্নে এবং জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ তৈরি হলে, জাতীয় ঐক্য ও আন্দোলনের শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হবে, বিশেষ করে একযোগে আন্দোলন ও নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে।
৫. বিএনপির শোভাযাত্রা ও রাজপথের শক্তি
গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির শোভাযাত্রা ও সমাবেশ ছিল দলটির একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি। বিএনপির নেতারা বলছেন, এই শোভাযাত্রাটি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ সমাবেশ, যা প্রমাণ করেছে যে বিএনপি এখনও দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি। বিএনপির কাছে মনে হচ্ছে, তাদেরকে বাইপাস করে কিংবা এড়িয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়, এবং সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
বিএনপির নির্বাচনী রোডম্যাপ ও আন্দোলনের পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, দলটি নির্বাচন ও সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে প্রস্তুত এবং তারা যতদিন পর্যন্ত নিরপেক্ষ রোডম্যাপ ঘোষণা করা না হবে, ততদিন আন্দোলন চালিয়ে যাবে। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা, অভ্যন্তরীণ ঐক্য শক্তিশালী করা, এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা — এই কৌশলগুলোই তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তি। নির্বাচনী রোডম্যাপের ঘোষণা বা ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো সুরাহা না হলে, বিএনপি রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রস্তুত, এবং তা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।