ইকুরিয়ার আতঙ্ক ‘জরিপ বাহিনী’
কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া খালের পাশের রাস্তা ধরে দক্ষিণ দিকে গেলে পাওয়া যায় বেয়ারা ছুরিমুইখা এলাকা, যেখানে বসবাস করেন কুলসুম বেগম। কুলসুমের পাশে একটি লম্বা টিনশেড ভবন রয়েছে, যার মালিক মো. জরিপ ওরফে কাল্যা জরিপ। একসময় এই জায়গাটি ছিল কুলসুমের। দশ বছর আগে মো. জরিপ তাঁর ২০ শতাংশ জমির মধ্যে ১৭ শতাংশ জমি জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করে নেন। সেই জমিতে ঘর বানিয়ে তিনি ভাড়া দেন। কুলসুম বলেন, “জাল কাগজ দিয়ে জমি দখল করেছে, আমি কিছু করতে পারিনি।”
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কুলসুমের জমি ছাড়াও মো. জরিপ গত দেড় দশকে অনেকের জমি দখল করেছেন। তাঁর দখল ও চাঁদাবাজির জন্য একটি বাহিনী রয়েছে, যা “জরিপ বাহিনী” নামে পরিচিত। এই বাহিনীর নৃশংসতার কারণে স্থানীয়রা আতঙ্কিত থাকেন এবং ভয়ে কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চান না। জরিপ বাহিনী ইকুরিয়া, তেঘরিয়া, বেয়ারা, আরাকুল, মুসলিমনগর ও ছুরিমুইখা এলাকায় অন্তত ৩০ বিঘা জমি ও ছয়টি বাড়ি দখল করেছে বলে জানা গেছে।
জমি দখল ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে মো. জরিপ বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। বর্তমানে ইকুরিয়া খালপাড়ে চারতলা ভবন ও পাশেই সাততলা ভবন নির্মাণ করছেন। তিনি হাসনাবাদ সুপারমার্কেট ও বেয়ারা জিয়সতলা এলাকায় টিনশেড ঘরও তৈরি করেছেন। স্থানীয় লোকজনের মতে, মো. জরিপ ছিলেন দিনমজুরের ছেলে এবং একসময় গুলিস্তানের একটি মার্কেটে পাঞ্জাবির দোকানে কাজ করতেন। পরে তিনি সন্ত্রাসী ‘আনসার বাহিনী’তে যোগ দেন। ২০০৫ সালে আনসার বাহিনীর প্রধানের মৃত্যুর পর তিনি ‘জরিপ বাহিনী’ গঠন করেন।
জরিপ বাহিনীর প্রায় ৭০ জন সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলো জেহাদ, আনিসুর রহমান, আসলাম, মোতালেব, আব্দুল্লাহ, রুবেল, ছাব্বির, শরিফ, রাজীব, কোঁকড়া জনি, সুমন, হাবিবুল্লাহ, লিপু, আনোয়ার, খোরশেদ, নওশাদ, সেলিম ও মাসুম। হাসনাবাদ সুপারমার্কেট ও ছুরিমুইখায় তাদের একটি টর্চার সেল ছিল, যেখানে মানুষকে নির্যাতন করা হতো।
দেহরক্ষী মো. ছাব্বিরের স্ত্রী অনামিকা আক্তারকে ২০২২ সালে জরিপের অনৈতিক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণে হত্যা করা হয়। এই মামলায় জরিপসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।
জরিপের ডেরায় মাদক সেবন ও নারী নিয়ে নাচের আসর বসানো হতো। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে র্যাবের অভিযানে এক তরুণীসহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার কাছ থেকে পিস্তল ও ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। জমি দখল নিয়ে বাধা দিলে নির্যাতনের শিকারও হতে হয় মানুষকে।
মো. জরিপের বিরুদ্ধে দেড় ডজনেরও বেশি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে খুন, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদক কারবার। তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্তি পান এবং আবার সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে মো. জরিপ আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে তাঁর বাহিনী এখনও এলাকায় সক্রিয় রয়েছে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান, “জরিপ একজন খারাপ লোক ও মাদক ব্যবসায়ী। বিভিন্ন কারণে মানুষকে নির্যাতন করেছে এবং তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।”