প্রবাসে গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলো
বিদেশে বসবাসের অভিজ্ঞতা যে কতটা জটিল এবং আবেগপূর্ণ হতে পারে, তা আমি এবং আমার স্ত্রী লন্ডনে বসবাস করতে গিয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি। নিজের দেশ থেকে দূরে থাকলেও, দেশের প্রতি মমত্ববোধ এবং ভালোবাসা আরও বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। দেশের যেকোনো সুখ-দুঃখ, রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা সমাজের পরিবর্তন—সবকিছুই যেন আরও স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়, কারণ প্রবাসে থাকলে আমাদের কাছে দেশ মানেই এক অমূল্য সত্তা, যা আমরা প্রতিনিয়ত মিস করি।
লন্ডনের কর্মব্যস্ত জীবনের মধ্যে দিনগুলো যেন মেশিনের মতো কাটছিল। কাজ, ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিকতা—সবকিছুই যেন এক নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা ছিল। কিন্তু ১৭ জুলাইয়ের পর থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন এক ভয়াবহ রূপ নেয়, যা আমাদের জীবনের ছন্দকে ভেঙে দেয়। শুরুটা ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে। দেশের শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার এবং সমতার দাবিতে পথে নামলো। এটি ছিল একটি শান্তিপূর্ণ এবং যৌক্তিক আন্দোলন, যা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু খুব দ্রুতই সেই আশা রূপ নেয় এক নিদারুণ আতঙ্কে।
জুলাইয়ের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলিতে সরকারের বেপরোয়া হামলা, পুলিশ এবং ছাত্রলীগের যৌথ বর্বরতা দেখে আমরা হতবাক হয়ে যাই। দেশের রাস্তায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে, তা ছিল অকল্পনীয়। ছাত্ররা যখন নিজেদের ভবিষ্যৎ এবং অধিকার নিয়ে লড়াই করছিল, তখন সরকারের বাহিনী তাদের ওপর নির্মমভাবে হামলা চালায়। গুলিবর্ষণ, গ্রেফতার, গুম, এবং অনবরত গণহত্যা—এসবের মধ্য দিয়ে ছাত্র আন্দোলন দমিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু দেশের তরুণ প্রজন্ম সহজে হাল ছাড়ার মতো ছিল না। একদিকে তারা তাদের জীবন বাজি রেখে লড়ছিল, অন্যদিকে আমরা প্রবাসে বসে কেবল উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছিলাম।
লন্ডন থেকে দেশের খবর পাওয়ার জন্য ইন্টারনেটই ছিল একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু সরকারের দমননীতির কারণে ইন্টারনেট এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়। দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া হয়ে দাঁড়ায় দুঃস্বপ্নের মতো। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় মানসিক সংকট আরও বেড়ে যায়। আমরা বুঝতে পারছিলাম না, আমাদের প্রিয়জনেরা কেমন আছেন, নিরাপদে আছেন কিনা। সংবাদমাধ্যমগুলোও নিরপেক্ষভাবে খবর প্রচার করতে পারছিল না। ফেসবুক, টুইটারসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা কিছু অপ্রতুল খবরের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছিল।
প্রতিদিনের জীবন যেন এক অজানা আতঙ্কের মধ্যে কাটছিল। কাজ করলেও মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হতো, দেশে কোনো ভয়ানক ঘটনা ঘটছে, আর আমি কিছুই করতে পারছি না। এই অসহায়ত্বের অনুভূতি আমাকে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলছিল। রাতের পর রাত ঘুমাতে পারতাম না। চোখ বন্ধ করলেই দেশের রাস্তায় ছাত্রদের রক্তাক্ত দেহ, গুলি, হামলা আর মানুষের আর্তনাদ দেখতে পেতাম। এই অস্থিরতা এবং উদ্বেগের মধ্যে পুরো পরিবার নিয়ে জীবন কাটানো যেন এক যন্ত্রণার নামান্তর ছিল।
এরপর আসে ৫ আগস্ট, যা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মহাগুরুত্বপূর্ণ দিন। সাধারণ জনগণ, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, শ্রমিক—সবার সম্মিলিত প্রতিরোধ হাসিনা সরকারের পতনের দিকে এগিয়ে যায়। ওই দিনটি যেন আমাদের জন্য মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিল। দেশের মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে শক্তিশালী প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল, তা ছিল অভূতপূর্ব। দীর্ঘদিনের দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ জেগে উঠেছিল, আর স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছিল। এই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী হতে না পারলেও, আমরা প্রবাসে থেকে সেই উত্তাল সময়ের প্রতিটি মুহূর্তকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি।
দেশ থেকে দূরে থাকলেও, এই সংকটময় সময়ে দেশের প্রতি আমাদের ভালোবাসা এবং কর্তব্যবোধ আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল। আমরা যত দূরে ছিলাম, দেশের জন্য ততই বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম। দেশের মানুষের কষ্ট আমাদের হৃদয়কে ছুঁয়ে গিয়েছিল।
আজ সেই দিনগুলো পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, লন্ডনে বসে দেশের এমন সংকটময় সময় পার করা ছিল অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। দেশের প্রতি ভালোবাসা তখন যেন আরও বেশি নিবিড় হয়ে উঠেছিল। আমাদের প্রিয় দেশ যখন সংকটে, তখন আমরা প্রবাসে থেকেও মনে প্রাণে দেশের সাথে ছিলাম। দেশের প্রতিটি আন্দোলন, প্রতিটি সংঘর্ষ আমাদের হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কেটে গিয়েছিল।
প্রবাসে থেকে দেশকে ভালোবাসার এই অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ। এক অর্থে, দূরত্ব আমাদের ভালোবাসাকে আরও শাণিত করে। দেশের প্রতিটি পরিবর্তন, প্রতিটি কষ্ট, এবং প্রতিটি জয় আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। প্রবাসে থেকে দেশের প্রতি এই সংযুক্তি যেন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রবাসে থেকে দেশের এই সংকটময় সময়ে আমি নিজেও হাত গুটিয়ে বসে থাকিনি। ১৭ জুলাই থেকেই যুক্তরাজ্যের বেশ কয়েকজন এমপি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে ইমেইলের মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাই। তাদের অবগত করি স্বৈরাচারী হাসিনা বাহিনীর অত্যাচার ও গণহত্যার বিষয়গুলো নিয়ে। এই ইমেইল যোগাযোগগুলো ছিল আমার প্রচেষ্টার একটি অংশ, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি।
এছাড়াও, এই অস্থিরতার সময়ে আমি প্রায়ই লন্ডনের Whitechapel এ অবস্থিত আলতাফ আলী পার্কের শহীদ মিনারে গিয়ে বসে থাকতাম, যেখানে মনের শান্তি খুঁজে পেতাম এবং দেশের প্রতি আমার মমত্ববোধ আরও গভীর হতো। এই জায়গাটি যেন আমার জন্য একটি মননের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল, যেখানে আমি দেশের সংকটকালীন সময়গুলোতে নিজেকে কিছুটা হলেও দেশে সংযুক্ত অনুভব করতাম।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগে লন্ডনে যে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন বা প্রতিবাদমূলক কর্মসূচিগুলো আয়োজন করা হতো, সেগুলোতে আমি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতাম। এসব সমাবেশে যোগদান ছিল আমাদের প্রতিবাদের ভাষা, আমাদের দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ। আমরা লন্ডনে থেকেও চেষ্টা করেছিলাম আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের তরুণদের ন্যায্য আন্দোলনের কথা তুলে ধরতে।
৫ আগস্ট
গত কয়েক রাতের মতো সেদিনও আমার ঘুম আসেনি। লন্ডনে বসে এক অজানা শঙ্কায় কাটছিল প্রতিটি রাত। “লং মার্চ টু ঢাকা” নামে শিক্ষার্থীরা যে গণআন্দোলনের ডাক দিয়েছিল, তা নিয়ে আজকে অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি চিন্তিত ছিলাম। সরকার কারফিউ জারি করেছে এবং তা আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করছে। চারদিকে এক থমথমে পরিস্থিতি, যেন একটা অশান্তির আগমনী সুর। ভেতরে ভেতরে আতঙ্কে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম, ভাবছিলাম—এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী? দেশের অবস্থা কী হবে?
ভোর ৫টার দিকে টানা জাগরণের পর অবশেষে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে পড়ি। তবে ঘুম টিকল না। সকাল ৭টার দিকে ঘুম ভেঙে গেল, মনের মধ্যে একরাশ উদ্বেগ। সকাল থেকেই বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের অবস্থান নিয়ে কোনো খবর আসছিল না। টিভি কিংবা অনলাইনে কোথাও কিছু পাচ্ছিলাম না। পুরো দেশ যেন নীরব হয়ে আছে। কারফিউয়ের কারণে গণমাধ্যমের সব খবরও যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। চিন্তা হতে লাগল, এইবারও কি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পার পেয়ে যাবেন? আরেকবার কি আমাদের স্বপ্ন ভেঙে যাবে?
তবে দুপুরের পর (বাংলাদেশের সময়) থেকেই একের পর এক সংবাদ আসতে শুরু করল। প্রথমে যাত্রাবাড়ী, তারপর শাহবাগ, উত্তরা—ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার সমাবেশের খবর আসছিল। যেন একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। দেশের ইন্টারনেট সংযোগও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করল, আর আন্দোলনের খবর দ্রুত পৌঁছতে লাগল। মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ভেতরে আশার আলো দেখা দিল। এরপর হঠাৎ করেই একটি বড় খবর এলো—সেনাপ্রধান বক্তব্য দেবেন! এই সংবাদে মনে হচ্ছিল, বড় কোনো পরিবর্তনের সময় হয়তো ঘনিয়ে এসেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই প্রতীক্ষিত খবরটি গণহত্যাকারী স্বৈরাচারী হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন! এ যেন বহুদিনের এক স্বপ্নের বাস্তব রূপ। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম, কিছুক্ষণ বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। এমনটি হবে, তা যেন কল্পনাতেও ভাবিনি। এই খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সবাই যেন এক অদ্ভুত আনন্দে ভেসে উঠলাম। আমার স্ত্রী, মামা রাকিবুল হক রুমন, মামি সর্না—সবাই মিলে একসঙ্গে উল্লাস করতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল, আমরা এক বিশাল মুক্তির স্বাদ পাচ্ছি।
তৎক্ষণাৎ ঠিক করলাম, এ বিজয়ের আনন্দে মিষ্টি কিনতে বের হব। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বের হলাম। লন্ডনের বাঙালি পাড়া খ্যাত আপটন পার্ক স্টেশনে নামার সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেলাম আরও ৩/৪ জন বাংলাদেশি তরুণ, যারা বিজয়ের আনন্দে মিষ্টিমুখ করাচ্ছে। তাদের চোখে-মুখে আনন্দের ঝলক, বিজয়ের উদযাপন। আমরা মিষ্টি কিনে তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। সেই আনন্দময় মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, প্রবাসের এই জীবনেও আমরা আমাদের দেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছি, বাংলাদেশের মুক্তির আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছি। লন্ডনের বাঙালিদের মধ্যে দ্রুতই এই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল।
বিকেলে ঠিক করলাম, পরিচিত সকল বাংলাদেশি বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে হোয়াইটচ্যাপেলে অবস্থিত আলতাফ আলী পার্কে যাব। বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই সেখানে আসার জন্য সম্মত হলো। বিকেলে যখন পার্কে পৌঁছালাম, দেখতে পেলাম হাজার হাজার বাংলাদেশি সেখানে জড়ো হয়েছে। তাদের চোখে-মুখে বিজয়ের আনন্দ, কেউ হাসছে, কেউ মিছিল করছে, কেউ স্লোগান দিচ্ছে। সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সবাই যেন উন্মুক্ত বাতাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছিল, দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান উদযাপন করছিল।
এই ৫ আগস্টের দিনটি আমার জীবনে একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। প্রবাসে থেকেও দেশের বিজয়ের আনন্দ আমাদের অন্তর ছুঁয়ে গিয়েছিল। আমরা যেন দূরে থেকেও আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে নতুন করে ফিরে পেলাম। এই দিনটি আমাদের জন্য শুধুমাত্র হাসিনার পতনের দিন নয়, এটি ছিল আমাদের জন্য নতুন আশার সূচনা, নতুন একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের শুরু।
– মাহমুদুল হাসান সাগর (লন্ডন, যুক্তরাজ্য) ।