
বিএনপির বিপরীতে ৩ শক্তির বৃহত্তর সমঝোতার চেষ্টা
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হচ্ছে—এটা হলো আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচন ধরে নিয়ে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ। মূলধারার বাইরে থাকা ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও ধর্মভিত্তিক সংগঠন ‘বৃহত্তর নির্বাচনী সমঝোতা’ গঠনের চেষ্টা করছে। যদিও এই প্রচেষ্টা আনুষ্ঠানিক জোট নয়, তবুও আসনভিত্তিক সহযোগিতা ও সমঝোতার মাধ্যমে এক ধরনের বিকল্প জোট-আকার নিচ্ছে।
সমঝোতার কাঠামো ও প্রধান দলগুলো
এই নির্বাচনী সমঝোতার কাঠামো মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত:
- জামায়াতে ইসলামি – এককভাবে নির্বাচন করবে, তবে নির্বাচনী সমঝোতায় উন্মুক্ত থাকবে।
- ধর্মভিত্তিক দলসমূহ – চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতৃত্বে এক প্ল্যাটফর্মে আসার চেষ্টা করছে।
- মধ্য ও মধ্য-বাম ঘরানার দল – জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, জেএসডি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ইত্যাদি বিএনপির বিপরীতে পৃথক উদ্যোগ নিচ্ছে।
এই দলগুলোর অভিন্ন কিছু এজেন্ডা দেখা যাচ্ছে, যেমন:
- সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা
- প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন
- রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতিতে সংস্কার
- লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতে রাজনৈতিক সংলাপ ও নির্বাচন-পূর্ব সংস্কার
ভোটের অঙ্ক ও রাজনীতির সমীকরণ
এই দলগুলোর একটি বড় যুক্তি হলো, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি এককভাবে বিপুল ভোট পাবে না। তাদের মতে, ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট ধানের শীষে জমা হলেও এবার তা ছড়িয়ে পড়বে। অতএব, যৌথভাবে মাঠে না নামলে বিএনপির জন্যও সমর্থন ধরে রাখা কঠিন হবে।
দলীয় ভোটের ইতিহাস (১৯৯১–২০০৮) বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিএনপির ভোটশক্তি ২২-৪১ শতাংশের মধ্যে থাকলেও, সেটি কখনোই একক ৬০-৭০ শতাংশ হয়নি। অতএব, নতুন দলগুলোর দাবি, সমঝোতা ছাড়া বিএনপিও জিততে পারবে না।
জোট নয়, সমঝোতা: বাস্তবতার মুখোমুখি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা সম্ভব হলেও জোট গঠন কঠিন:
- কওমি ঘরানার দলগুলো জামায়াতের মতাদর্শিক অবস্থানকে মওদুদীবাদী মনে করে; ফলে তাদের সঙ্গে জোটের সম্ভাবনা নেই।
- চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বলছে, জোট নয়, সমঝোতা হতে পারে। তাদের লক্ষ্য প্রতিটি আসনে একক ইসলামী প্রার্থী।
- জামায়াত বলছে, আদর্শগত ও কৌশলগত কারণে জোট নয়, কিন্তু ‘আসন সমঝোতা’ বা সমর্থন বিনিময় সম্ভব।
বিএনপির সংকট: নেতৃত্বের দ্বিধা ও মাঠ পর্যায়ে প্রতিরোধ
বিএনপি একদিকে একাধিক দলকে আসন ছাড়ার ইঙ্গিত দিলেও, স্থানীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক। যুগপৎ আন্দোলনের অংশীদার দলের নেতাদের উপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এই দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি সমঝোতাকে জটিল করে তুলছে।
একইসঙ্গে, বিএনপির সংস্কারে অনড় অবস্থান অন্যান্য দলগুলোকে তাদের থেকে দূরে ঠেলছে—এই সুযোগ নিয়েই এনসিপি ও অন্যান্য দল বিকল্প মেরুকরণে উৎসাহী হচ্ছে।
নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা: প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিশ্চিত করতে সমঝোতার প্রয়াস
তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের পর দেশের প্রায় অর্ধেক ভোটার নতুন ভোটার। তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হলে বিরোধী দলগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
‘বিএনপি বনাম সবাই’ কাঠামো তৈরির মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তোলাই বৃহত্তর নির্বাচনী সমঝোতার অন্যতম লক্ষ্য। এভাবে দোদুল্যমান ভোটারদের মনে ভরসা সৃষ্টি করাই হচ্ছে মূল কৌশল।
বাংলাদেশের রাজনীতি এক সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আওয়ামী লীগ যদি সত্যিই নির্বাচনের বাইরে থাকে, তাহলে বিরোধী রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হবে, তা পূরণে এখন চলছে নতুন মেরুকরণের খেলা।
এই মেরুকরণে ধর্মভিত্তিক দল, সংস্কারপন্থি গোষ্ঠী, জামায়াত ও মধ্যপন্থি দলগুলো একটি ‘আসনভিত্তিক সহযোগিতা প্ল্যাটফর্ম’ গঠনের দিকে এগোচ্ছে। বাস্তবতা হলো, এই সমঝোতা একদিকে যেমন বিএনপিকে চাপে ফেলবে, অন্যদিকে দেশের রাজনীতিতে নতুন শক্তির আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে। তবে আদর্শিক মতানৈক্য, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও মাঠপর্যায়ের সংঘাত—সমঝোতার পথে প্রধান বাধা হয়ে থাকছে।