
আলোচনার কেন্দ্রে নির্বাচনের সময়
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তেজনা, কৌশল ও কূটনীতি নতুন মাত্রা পেয়েছে তারেক রহমান ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠকের মধ্য দিয়ে। লন্ডনের হোটেল ডোরচেস্টারে শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ বৈঠক ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গন, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।
বৈঠকের তাৎপর্য ও পটভূমি
এই বৈঠক এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন নিয়ে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে এবং বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করে সময় এগিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছে। ড. ইউনূস চার দিনের সফরে লন্ডনে অবস্থান করছেন, যেখানে তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকে বসবাস করছেন এবং সেখান থেকেই দল পরিচালনা করছেন।
বৈঠকের আগে পর্দার আড়ালে তারেক রহমান ও সরকারের প্রতিনিধিদের মধ্যে একাধিক অনানুষ্ঠানিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সূত্র অনুযায়ী, এসব আলোচনার মাধ্যমে বৈঠকের আলোচ্যসূচি নির্ধারণ এবং সমঝোতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো স্পষ্ট করা হয়েছে।
আলোচ্য বিষয়সমূহ
বিএনপি ও সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল—
নির্বাচনের সময় এগিয়ে আনা:
বিএনপির প্রধান দাবি হলো চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন। তবে তারা জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতেও রাজি, যদি তা রোজার আগেই হয়। এ সময় নির্ধারণ নিয়ে মতপার্থক্য দুই পক্ষের মধ্যে এখনও বিদ্যমান।
নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা ও প্রশাসনিক সংস্কার:
সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং প্রশাসনে ‘স্বৈরাচারের দোসরদের’ প্রভাব দূর করার বিষয়টি বিএনপির পক্ষ থেকে জোরালোভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
আইনের শাসন ও বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা:
দেশে আদালতের রায় মেনে চলা, রাজনৈতিক মামলাগুলোর নিরপেক্ষ নিষ্পত্তি এবং সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে।
জুলাই ঘোষণাপত্র:
আসন্ন জুলাই মাসে একটি যুগান্তকারী রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র আসতে পারে বলে দুই পক্ষের আলোচনা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, যেখানে নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংস্কার বিষয়ে সমন্বিত রূপরেখা থাকতে পারে।
বিএনপির কৌশল ও তারেক রহমানের ভূমিকা
বিএনপির স্থায়ী কমিটি সম্পূর্ণ আস্থা রেখে আলোচনার ভার দিয়েছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর। তারেক রহমানের এখন দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনাও বেড়েছে, কারণ সরকার জানিয়েছে তাঁর দেশে ফেরায় আর কোনো আইনি বাধা নেই।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও জনমনোভাব
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বৈঠককে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, এই বৈঠক থেকে ‘জাতীয় ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য ফয়সালা’ আসবে বলে তাঁদের প্রত্যাশা। লন্ডনে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝেও বৈঠক ঘিরে ব্যাপক আগ্রহ ও উত্তেজনা দেখা গেছে।
মূল্যায়ন ও সম্ভাব্য প্রভাব
এ বৈঠক যদি বাস্তব ফলাফল বয়ে আনে, তবে সেটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। নির্বাচনের সময় নির্ধারণ, প্রশাসনিক সংস্কার ও রাজনৈতিক সমঝোতার একটি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি হলে, তা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
তবে এ আলোচনার ফলাফল নির্ভর করবে দুই পক্ষের সদিচ্ছা, বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা এবং সর্বোপরি জনগণের চাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাবের ওপর। এখন সবার চোখ আগামী দিনে–বিশেষ করে সম্ভাব্য ঘোষণাপত্র এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরার সময়ের দিকে।
এই বৈঠক নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এক নতুন মোড়ে নিতে পারে। তবে বাস্তব সমাধানের জন্য দরকার শুধু আলোচনা নয়, কার্যকর বাস্তবায়ন। সেই বাস্তবায়নের দিশা দিতেই হয়তো আজকের লন্ডন বৈঠককে মনে রাখা হবে এক ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে।