
রায় বাতিল, খালাস পেলেন জামায়াত নেতা আজহার
জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সব অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করে এই সিদ্ধান্ত দেয়। এই রায় দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও বিচারব্যবস্থায় তাৎপর্যপূর্ণ বিতর্ক এবং প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
রায়ের পটভূমি ও বিচারিক প্রক্রিয়া
আজহারুল ইসলামকে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৬টি ঘটনায় হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। ২০১৯ সালে আপিল বিভাগ এই রায় বহাল রাখে। তবে ২০২0 সালে তিনি রিভিউ আবেদন করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আপিল শুনানি ফের শুরু হয়। এরপর ২০২৫ সালের ২৭ মে আপিল বিভাগ সর্বসম্মত রায়ে তাঁকে বেকসুর খালাস দেয়।
আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ
আদালত চারটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে রায় দেয়:
- পূর্ববর্তী রায়ে বিচারিক প্রক্রিয়ার মূলনীতি লঙ্ঘন করে অপরাধ প্রমাণ ছাড়াই সাজা দেওয়া হয়েছিল।
- সাক্ষ্য-প্রমাণ যাচাই না করেই ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়, যা বিচার প্রক্রিয়ার বড় ভুল।
- এটি ছিল “ট্রাভেস্টি অব জাস্টিস” বা বিচারের নামে অবিচার।
- আদালতে পেশকৃত তথ্য-প্রমাণ যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি।
প্রতিক্রিয়া: বিভক্ত মতামত
আইনজীবীদের বক্তব্য:
আজহারের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে সত্যের জয় হয়েছে। তিনি এটিকে ‘সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিস’-এর অবসান বলেও মন্তব্য করেন।
সরকারি পক্ষ:
রাষ্ট্রের তরফ থেকে এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়া হয়নি, তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সামাজিক মাধ্যমে রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া:
- সমর্থক মহলে উল্লাস: সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে জামায়াত-সমর্থিত আইনজীবী ও নেতাকর্মীরা রায়ের পর উল্লাস প্রকাশ করেন, ‘নারায়ে তাকবির’ ধ্বনি দেন এবং শোকরানা নামাজ আদায় করেন।
- বিরোধিতাও তীব্র: বাম রাজনৈতিক দল, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীসহ বিভিন্ন সংগঠন রায়ের প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ করে। সামাজিক মাধ্যমে নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভ দেখা যায়।
আজহারুল ইসলামের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত পটভূমি
- জন্ম: ১৯৫২ সালে রংপুরের বদরগঞ্জে।
- একাত্তরে ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি।
- মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘আলবদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডার’ হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ ওঠে।
- স্বাধীনতার পর সৌদি আরবে পালিয়ে যান, ১৯৭৫ সালে দেশে ফেরেন।
- জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ও প্রমাণ
২০১২ সালে তদন্ত শুরু হয় এবং ২০১৩ সালে তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- বদরগঞ্জে ১৪ জনকে হত্যা
- ঝাড়ুয়ারবিল ও আশপাশের গ্রামে ১,৪০০ জন হিন্দু গ্রামবাসীকে হত্যা
- কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপকসহ পাঁচজনকে হত্যা
- একজন বীরাঙ্গনাকে ধর্ষণের অভিযোগ
- লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনের অভিযোগ
এই রায় বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, রাজনৈতিক ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীকী মূল্যবোধের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। আদালতের পর্যবেক্ষণ একদিকে বিচারিক প্রক্রিয়ার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে, অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তুলেছে। আজহারের খালাস শুধু একটি আইনি রায় নয়, বরং এটি জাতিকে ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ইতিহাসের ভারসাম্য রক্ষার এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে।