
২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবন বহাল রেখে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আবরার ছিলেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এই নির্মম হত্যাকাণ্ড দেশে তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দার সৃষ্টি করে।
হত্যাকাণ্ডের পরপরই আবরারের বাবা চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। তদন্ত শেষে একই বছরের ১৩ নভেম্বর ২৫ জন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। উল্লেখযোগ্য যে, সব আসামিই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ছিলেন, যা পরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
বিচারিক প্রক্রিয়া ও রায়:
২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলার রায় দেন। ট্রাইব্যুনাল ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। বিচারক উল্লেখ করেন, আসামিরা শিবির সন্দেহে আবরারের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলে এবং দলবদ্ধভাবে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। এই ঘটনা জাতিকে ব্যথিত করে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হয়।
হাইকোর্টের পর্যালোচনা ও পূর্ণাঙ্গ রায়:
ফৌজদারি মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে হাইকোর্টের অনুমোদন প্রয়োজন, যেটিকে ডেথ রেফারেন্স বলা হয়। পাশাপাশি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আপিল ও জেল আপিল করেন। ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিচারিক আদালতের রায় হাইকোর্টে পৌঁছায়।
২০২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ডেথ রেফারেন্স এবং আপিল শুনানি শেষে ১৬ মার্চ হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করে। বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের বেঞ্চ বিচারিক আদালতের রায় বহাল রাখেন। এরপর ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের শেষে ১৩১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
আসামিদের অবস্থা:
- মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২০ জন: সবাই বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ৩ জন আগে থেকেই পলাতক এবং একজন, মুনতাসির আল (জেমি), কারাগার থেকে পালিয়ে গেছে।
- যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ৫ জন: মুহতাসিম ফুয়াদ হোসেন, মো. আকাশ হোসেন, মুয়াজ আবু হুরায়রা, অমিত সাহা এবং ইশতিয়াক আহমেদ।
মোট ২৫ জন দণ্ডিত আসামির মধ্যে ৪ জন বর্তমানে পলাতক বলে রাষ্ট্রপক্ষ জানিয়েছে।
১. ন্যায়বিচারের প্রতিফলন: এই মামলায় বিচারিক ও আপিল আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট—নির্মম, পরিকল্পিত ও দলবদ্ধ হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান অপরিহার্য।
- সাংগঠনিক সহিংসতার প্রতিফল: মামলার সব আসামি একটি ছাত্র সংগঠনের সদস্য হওয়ায় এটি বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির সহিংস দিক নিয়ে নতুন করে ভাবনার সুযোগ তৈরি করেছে।
- আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা: প্রায় পাঁচ বছরের বিচারিক ও আপিল প্রক্রিয়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ সময় লাগার বিষয়টি তুলে ধরে। তবে, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের মাধ্যমে এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পৌঁছেছে।
- আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: হাইকোর্টের রায় এটাই দেখায় যে, সংগঠনের পরিচয়, প্রভাব কিংবা অবস্থান বিবেচনায় না নিয়ে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া সম্ভব।