
জনগণ তাড়াতাড়ি ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলছে না
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, নির্বাচনী প্রস্তুতি, রোহিঙ্গা সংকট এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য দিয়েছেন। এই সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস দেশের জনগণের সমর্থন ও অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করেন, তবে পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কাও স্বীকার করেন।
ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের জনগণ এখনও অন্তর্বর্তী সরকারের উপর আস্থা রাখছে এবং সরাসরি তাদের বিদায় চাচ্ছে না। বরং তারা একটি “ভালো নির্বাচন” প্রত্যাশা করছে। এটি ইঙ্গিত করে, সাধারণ জনগণ এখনো নির্বাচনপূর্ব দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বদলে একটি কার্যকর এবং দ্রুত নির্বাচন চায়, যাতে গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্পন্ন হয়।
তিনি এও জানান, সংস্কারের তালিকা অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনের সময় নির্ধারিত হবে—সংস্কারের পরিমাণ কম হলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে পারে, আর যদি সংস্কার বড় পরিসরে হয় তবে ২০২৬ সালের জুন নাগাদ নির্বাচন সম্ভব। এটি বোঝায় যে সরকার সংস্কারের ওপর ভিত্তি করে সময়সূচি নির্ধারণ করছে, যা কিছুটা অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দেয় এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জন্যও নতুন সম্ভাবনা ও উদ্বেগ তৈরি করে।
আলজাজিরার এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস স্বীকার করেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে জনগণের মধ্যে যে ‘মধুচন্দ্রিমা’ বা উচ্চ প্রত্যাশা ছিল, তা কিছুটা নড়বড়ে হতে শুরু করেছে। কারণ, পুরনো ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর প্রভাব, রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নেওয়ার প্রবণতা এবং নানা প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রয়াসের কথা জানান। কিন্তু এখানেও তিনি বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন যে, বাংলাদেশ এককভাবে এই সংকটের সমাধান করতে পারবে না; আন্তর্জাতিক চাপ এবং বোঝাপড়া ছাড়া এটি সম্ভব নয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল অংশ ছিল নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনা। ড. ইউনূস বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা, এবং নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এটি স্পষ্ট করে দেয় যে, অন্তর্বর্তী সরকার সরাসরি কোনো পক্ষকে নির্বাচন থেকে বাদ দিচ্ছে না, তবে আইনি কাঠামোর আওতায় রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান নির্ধারিত হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ব্যাংককে বৈঠকের প্রসঙ্গও গুরুত্বপূর্ণ। ড. ইউনূস সেখানে শেখ হাসিনাকে “চুপ রাখার” অনুরোধ করলেও মোদি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষমতার কথা জানান। এটি ইঙ্গিত করে, আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ নিয়ে ভারত কিছুটা সতর্ক ভূমিকা নিচ্ছে এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের নীতিগত সমর্থন সীমিত হয়ে আসছে।
ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে “সহযোগিতার নীতি” নিয়ে এগোতে চান বলে জানিয়েছেন। এটি পরিষ্কার করে যে, নতুন সরকারের বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য হচ্ছে ভারসাম্য রক্ষা করে বহুপাক্ষিক সমর্থন আদায় করা এবং কোনো একক শক্তির উপর নির্ভরশীল না হওয়া।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই সাক্ষাৎকার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আত্মবিশ্বাস, ভবিষ্যৎ নির্বাচনী পরিকল্পনা, রোহিঙ্গা সংকটের আন্তর্জাতিক মাত্রা, এবং বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করে। তবে, রাজনৈতিক শূন্যতা, পুরনো গোষ্ঠীর প্রভাব এবং নির্বাচনী অনিশ্চয়তা এখনো বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে।