
ঘোষণাপত্র পাঠে শেষ হলো ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি
২০২৫ সালের ১২ এপ্রিল, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট, বাংলাদেশ’ আয়োজিত ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মসূচি ছিল গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলা ও মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে একটি গণজাগরণমূলক প্রতিবাদ এবং আন্তর্জাতিকভাবে সংহতি জানানোর আয়োজন। অংশগ্রহণকারী জনগণের বিশাল উপস্থিতি ও স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্য দিয়ে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও মানবিক বার্তা বহন করেছে।
সমাবেশের বৈশিষ্ট্য ও জনসম্পৃক্ততা
- সমাবেশে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।
- হাতে ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা, প্ল্যাকার্ড, এবং স্লোগান—যেমন: “ফিলিস্তিন মুক্ত করো”, “গাজা রক্তে রঞ্জিত, বিশ্ব কেন নীরব”।
- রাজধানীর বহু এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে এবং যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
- পানি সরবরাহসহ মানবিক ব্যবস্থাপনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠে, যা কর্মসূচির প্রতি সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতা প্রকাশ করে।
ঘোষণাপত্রের বিশ্লেষণ
ঘোষণাপত্র পাঠ করেন মাহমুদুর রহমান, যেখানে চারটি স্তরে দাবি ও অঙ্গীকার উপস্থাপন করা হয়:
১. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি দাবি
- গাজার ওপর চলমান গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের আওতায় আনা।
- যুদ্ধবিরতির পরিবর্তে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ।
- ১৯৬৭ সালের সীমানা ফিরিয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরির আহ্বান।
- পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি।
- ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় পদক্ষেপ।
এখানে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতি শুধু একটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নয়, বরং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সামষ্টিক ব্যর্থতা। পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা এবং দখলদার রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থনকে একপ্রকার চরম নৈতিক পরাজয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
২. মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান
- ইসরায়েলের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা।
- বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ।
- গাজার জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা।
- কূটনৈতিক উদ্যোগে ইসরায়েলকে একঘরে করা।
- ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান।
মুসলিম উম্মাহকে তাদের আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওআইসি ও মুসলিম সরকারগুলোর নির্লিপ্ততাকে কঠোরভাবে সমালোচনা করা হয়েছে এবং তাদেরকে কার্যকর ভূমিকায় নামতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
৩. বাংলাদেশের সরকারের প্রতি দাবি
- পাসপোর্টে ‘Except Israel’ শর্ত পুনর্বহাল।
- ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল।
- রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ পাঠানো।
- জায়নবাদী পণ্যের বর্জন নিশ্চিত করা।
- ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী সরকারের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
- পাঠ্যবইয়ে মুসলিম ইতিহাস ও সংগ্রামের অন্তর্ভুক্তি।
এখানে জাতীয় পর্যায়ে সরকারের করণীয় স্পষ্টভাবে নির্দেশ করা হয়েছে, যা রাষ্ট্রের নীতি ও কূটনীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এর মাধ্যমে জাতিকে তাদের নৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
৪. নিজেদের প্রতি অঙ্গীকার
- ইসরায়েলপন্থী সব পণ্য বয়কট।
- সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করা।
- ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ।
- ঘর থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনে প্রতিরোধ চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া।
ঘোষণার শেষভাগে ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রজন্মগত প্রস্তুতির দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। এখানে একটি আত্ম-অনুশীলনের আহ্বান রয়েছে—যেখানে প্রতিটি নাগরিককে দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি শুধু একটি সমাবেশ নয়, এটি বাংলাদেশের মানুষদের পক্ষ থেকে বিশ্ব ও মুসলিম উম্মাহর প্রতি একটি জোরালো বার্তা। এই সমাবেশে গাজা এবং ফিলিস্তিনের প্রতি যে ঐকান্তিকতা প্রকাশ পেয়েছে, তা দেশব্যাপী একটি মানবিক ও আদর্শিক আন্দোলনের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
ঘোষণাপত্রে যে চার স্তরের বার্তা দেওয়া হয়েছে—তা একটি সমন্বিত রাজনৈতিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান প্রতিফলিত করে। এটি শুধুই প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য নয়—বরং এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি রূপরেখা এবং প্রতিশ্রুতির দলিল।