
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের এক স্টেশনেই ব্যয় কমছে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প: ব্যয় হ্রাসের উদ্যোগ ও বাস্তবতা
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের অন্যতম বড় মেগা প্রকল্প। শুরু থেকেই এই প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে নানা বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের তত্ত্বাবধানে ব্যয় কমানোর কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ভাঙ্গা জংশন স্টেশন: ব্যয় কমানোর প্রতীকী দৃষ্টান্ত
ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন স্টেশন নির্মাণে ব্যয় হ্রাসের উদ্যোগ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যয় কমানোর বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে।
- প্রথমে ব্যয় নির্ধারিত ছিল: ১৫৩ কোটি টাকা
- বর্তমানে কমিয়ে আনা হয়েছে: প্রায় ১৪.৫ কোটি টাকা
এই ব্যয় হ্রাসের জন্য স্টেশনের অভ্যন্তরীণ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যেমন:
- টাইলস ও কমোডের মান পরিবর্তন
- এসি বাতিল করে পাখা বসানো
- ঠিকাদারের সঙ্গে দর-কষাকষি করে অতিরিক্ত খরচ কমানো
পুরো প্রকল্পে ব্যয় হ্রাসের চিত্র
২০১৬ সালে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ছিল ৩৪,৯৮৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয় ৩৯,২৪৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ সংশোধনের পর ও ব্যয় হ্রাসের ফলে এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৮,৬১০ কোটি টাকা—অর্থাৎ প্রায় ১,৮৬০ কোটি টাকা ব্যয় হ্রাস হয়েছে।
ব্যয় হ্রাস হয়েছে যেসব খাতে:
- নকশা ও জরিপ ফি
- সংকেত ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা
- রেলক্রসিং গেট
- নদীশাসন
- পাথরবিহীন রেলপথ নির্মাণ
- মূল্য সমন্বয়ের জন্য সংরক্ষিত তহবিল
এ ছাড়াও, চীনা অর্থায়নের একটি অংশ—৬০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক ঋণ ফেরত পাঠানো হয়েছে।
রাজনৈতিক চাপে অবাস্তব ব্যয় বৃদ্ধি
ভাঙ্গা জংশন স্টেশনটি লোকালয় থেকে দূরে অবস্থিত, তবে রাজনৈতিক প্রভাবে এটি বিলাসবহুলভাবে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
- সংসদের তৎকালীন চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন এবং তার ভাই নিক্সন চৌধুরীর চাপে স্টেশনটি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়।
- তারা দাবি করেন, ভবিষ্যতে এখানে অলিম্পিক ভিলেজ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গড়ে তোলা হবে।
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবতার ভিত্তিতে নয় বরং রাজনৈতিক প্রভাবের ফলাফল, যা জনস্বার্থে প্রশ্নবিদ্ধ।
ট্রেন চলাচলে সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবতা
প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিমি রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে।
- প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রতিদিন ২৪ জোড়া (৪৮টি) ট্রেন চলার কথা ছিল।
- বাস্তবে চলছে মাত্র ১০টি যাত্রীবাহী ট্রেন, মালবাহী ট্রেন নেই।
- মোংলা বন্দর, বেনাপোল ট্রানজিট, পায়রা বন্দর সংযোগ—সবই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পরিকল্পনা।
জনবল সংকট, ইঞ্জিন ঘাটতি, এবং আয়বর্ধক কৌশলের অভাব এই সীমাবদ্ধতার মূল কারণ।
বিশেষজ্ঞ মতামত ও সুপারিশ
বুয়েটের অধ্যাপক হাদীউজ্জামান বলেন, ব্যয় কমানো অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন—
- প্রকল্প গ্রহণের আগে সুষ্ঠু মূল্যায়ন প্রয়োজন
- বিনিয়োগ আদৌ উপকার বয়ে আনবে কি না, তা বিবেচনায় রাখতে হবে
- প্রকল্প শেষে লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণ ও প্রক্ষেপণ অর্জনের মূল্যায়ন জরুরি
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পে ব্যয় হ্রাসের প্রচেষ্টা দেশের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে এক নতুন দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক প্রভাব, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, এবং সীমিত ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, ব্যয় হ্রাস ও কার্যকর তদারকি সঠিক পথে পরিচালিত হলে ভবিষ্যতের মেগা প্রকল্পগুলো আরও টেকসই, স্বচ্ছ এবং ফলপ্রসূ হতে পারে।