April 25, 2025
পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, বিতর্কে এনসিপির নেতারা

পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, বিতর্কে এনসিপির নেতারা

মার্চ ২৪, ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দলটির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ এবং উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের মধ্যে সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এনসিপির অভ্যন্তরীণ ঐক্যের প্রশ্ন তুলেছে।

মূল বিতর্কের সূত্রপাত

১১ মার্চ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে এনসিপির দুই নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম সাক্ষাৎ করেন। তবে এই বৈঠকের উদ্দেশ্য ও আলোচনা নিয়ে দুই নেতার বক্তব্যে গুরুতর অসঙ্গতি দেখা গেছে।

হাসনাত আবদুল্লাহর দাবি:

  • সেনাবাহিনী ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করছে।
  • ভারতের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে এই পরিকল্পনার পেছনে।
  • সেনানিবাসে বৈঠকে এই বিষয়টি তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।

সারজিস আলমের পাল্টা বক্তব্য:

  • সেনাবাহিনী তাদের ডেকে নেয়নি; বরং তারা নিজেরাই আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
  • ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নিয়ে আলোচনা হলেও এটি চাপ প্রয়োগের মতো ছিল না।
  • হাসনাতের পোস্টের ভাষা ও ব্যাখ্যা বাস্তব আলোচনার চেয়ে অনেক বেশি উগ্র।

এই দুই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের পর এনসিপির আরও কিছু নেতা ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দলের অভ্যন্তরীণ বিভাজন প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।

নেতাদের প্রতিক্রিয়া: বিভক্ত এনসিপি

  • এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘‘দুজনের একজন মিথ্যা বলছেন। এটা চলতে পারে না।’’
  • মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী হাসনাতের পোস্টকে “শিষ্টাচারবর্জিত” বলে মন্তব্য করেন।
  • দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব জানান, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দল ঐক্যবদ্ধ থাকলেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈঠক নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আছে।

এনসিপির অন্যান্য নেতাদের পোস্টে অভিযোগ উঠে, কিছু নেতা নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ও বিতর্ক সৃষ্টি করতে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিষয় ফেসবুকে প্রকাশ করছেন, যা দলের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর।

সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া ও বিতর্কের আরও বিস্তার

সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজ এনসিপির সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে সেনাসদরের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়—

  1. সেনাবাহিনী বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করলেও ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ গঠনের জন্য চাপ প্রয়োগের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছে।
  2. সেনাবাহিনীর দাবি, এনসিপির নেতারাই আলোচনা করতে চেয়েছিলেন।
  3. হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক স্টান্টবাজি’ এবং ‘অপরিপক্ব গল্পের সম্ভার’ বলে উল্লেখ করা হয়।

আইএসপিআর এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি, তবে সেনাসদরের বক্তব্য নেত্র নিউজে প্রকাশের পর এনসিপির নেতাদের অবস্থান আরও চাপের মুখে পড়ে।

تحليل ও পর্যালোচনা

1. এনসিপির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা প্রকাশ্যে এসেছে

একটি নতুন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা এভাবে পরস্পরের বিপরীত বক্তব্য দিলে তা দলের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দেয়। রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত অভ্যন্তরীণ বিষয় দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সমাধান করে, কিন্তু এনসিপির ক্ষেত্রে তা হয়নি।

2. সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততার বিতর্ক দলটির ভাবমূর্তিতে আঘাত হেনেছে

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা স্পর্শকাতর বিষয়। এনসিপির শীর্ষ নেতারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় জড়িয়েছেন, যা তাদের দলকে ‘প্রশাসননির্ভর’ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

3. নেতৃত্ব সংকট ও সমন্বয়হীনতা

হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য এবং পরে সারজিস আলমের সংশোধিত অবস্থান প্রমাণ করে যে এনসিপির নেতৃত্ব পর্যায়ে মতৈক্যের অভাব রয়েছে। এতে দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।

4. আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ‘রিফাইন্ড’ ধারণা কতটা বাস্তবসম্মত?

‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ গঠন আদৌ সম্ভব কিনা, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী দল এবং সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ ধরনের নতুন দল গঠন করা প্রায় অসম্ভব।

এনসিপির সাম্প্রতিক বিতর্ক দলটির অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক দুর্বলতা, নীতি নির্ধারণের অভাব ও সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট করেছে। সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক ও ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য তাদের উপর আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে।

দলটি যদি দ্রুত এই সংকটের সমাধান করতে না পারে, তাহলে এটি একটি অল্পস্থায়ী রাজনৈতিক উদ্যোগে পরিণত হতে পারে। ভবিষ্যতে নেতৃত্বের ঐক্য, সংগঠনের শৃঙ্খলা এবং জনসমর্থন টিকিয়ে রাখা এনসিপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

Leave a Reply