
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাবে কে
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এটি কেবল দুর্ঘটনা নয়; দুর্বল তদারকি, নিম্নমানের সরঞ্জাম এবং অসচেতনতার সম্মিলিত ফল। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর গাফিলতি ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে এই ঝুঁকি দিন দিন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
দুর্ঘটনার কারণ ও বিশ্লেষণ
১. গ্যাস লিকেজ ও নিম্নমানের সরঞ্জাম:
- লিকেজ হলেই আগুনের সংস্পর্শে বিস্ফোরণের আশঙ্কা থাকে।
- নিম্নমানের রেগুলেটর, পাইপ ও ভাল্ভ ব্যবহারের কারণে গ্যাস লিকেজ হয়।
- মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারে উচ্চচাপে গ্যাস ভরার ফলে বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়ে।
- ক্রস ফিলিং ও অননুমোদিত গ্যাস রিফিলিং:
- এলপিজি কোম্পানিগুলো অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে, কিন্তু অনেক জায়গায় অনুমোদন ছাড়া হাতের সাহায্যে গ্যাস ভরা হয়, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
- ক্রস ফিলিংয়ে ভাল্ভ বসানোর পদ্ধতি যথাযথ না থাকায় লিকেজের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- পরিবহন ও সংরক্ষণজনিত ত্রুটি:
- সিলিন্ডার কাত করে রাখা, অযত্নে ফেলে রাখা বা পরিবহনের সময় ছুড়ে ফেলা সিলিন্ডারের কাঠামো দুর্বল করে দেয়।
- রান্নার সময় চুলার পাশে সিলিন্ডার রাখলে অতিরিক্ত তাপে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
- গাড়ির জন্য মানহীন সিলিন্ডারের ব্যবহার:
- বহু যানবাহনে অননুমোদিত ও নিম্নমানের সিলিন্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে।
- দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে সিলিন্ডারের অভ্যন্তরীণ ক্ষয় হয়, যা বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ।
- বিআরটিএর তদারকির অভাবে যানবাহনে নিম্নমানের গ্যাস সংযোগ অব্যাহত রয়েছে।
সরকারি তদারকির দুর্বলতা ও ঝুঁকি বৃদ্ধি
- একটি মাত্র পরীক্ষাগার: বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীনে কেবল চট্টগ্রামে একটি পরীক্ষাগার রয়েছে, যা সারাদেশের সিলিন্ডার পরীক্ষা করতে সম্পূর্ণ অপ্রতুল।
- নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদাসীনতা: বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দুই লাখের বেশি মানহীন সিলিন্ডার ব্যবহার হচ্ছে, অথচ কার্যকর তদারকি নেই।
- নিরাপত্তা পরীক্ষার অনিয়ম: অনুমোদিত এলপিজি কোম্পানিগুলো নির্ধারিত সময় পর সিলিন্ডার পরীক্ষা করলেও বাজারের অনেক সিলিন্ডার এর বাইরে থেকে যাচ্ছে।
- গাড়ির ক্ষেত্রে সঠিক পরিদর্শনের অভাব: সিএনজি ফিলিং স্টেশনে মানহীন সংযোগ ব্যবহৃত হলেও বিআরটিএ যথাযথ ব্যবস্থা নেয় না।
সমাধানের উপায় ও করণীয়
- সিলিন্ডার ব্যবহারের কড়াকড়ি নিয়ম ও মান নিয়ন্ত্রণ:
- মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের সিলিন্ডার নিষিদ্ধ করতে হবে।
- ক্রস ফিলিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
- নিয়মিত নিরাপত্তা পরীক্ষা ও সরকারি তদারকি বাড়ানো:
- এলপিজি ও সিএনজি সিলিন্ডারের মান পরীক্ষার জন্য আরও পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে।
- বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও বিআরটিএর সমন্বয়ে কঠোর পরিদর্শন চালানো উচিত।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি:
- রান্নার সময় চুলার কাছ থেকে সিলিন্ডার দূরে রাখা ও নিয়মিত গ্যাস লিকেজ পরীক্ষা করা উচিত।
- যানবাহনের জন্য অনুমোদিত ও সঠিক মানের সিলিন্ডার ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
- আইন ও শাস্তির কঠোর বাস্তবায়ন:
- অননুমোদিত সিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
- মানহীন রেগুলেটর ও পাইপ সরবরাহ বন্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা দুর্বল তদারকি ও অসচেতনতার কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে। এটি প্রতিরোধ করতে হলে কঠোর তদারকি, আইন প্রয়োগ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও গ্যাস সংযোগ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে হবে। অন্যথায় এ ধরনের দুর্ঘটনা অব্যাহত থাকবে, যা মানুষের জীবন ও সম্পদের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।