
বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) ও সাম্প্রতিক ট্রেন হাইজ্যাক: নতুন উত্তেজনা
ট্রেন হাইজ্যাক ও সামরিক অভিযান
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে সাম্প্রতিক ট্রেন হাইজ্যাকের ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। মঙ্গলবার, কোয়েটা থেকে পেশাওয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনটি বেলুচিস্তানের একটি পাহাড়ি টানেলের কাছে সশস্ত্র বিএলএ যোদ্ধাদের হাতে হাইজ্যাক হয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কয়েক ঘণ্টার সামরিক অভিযানের পর ৩৪৬ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে এবং ৩৩ জন হামলাকারীকে হত্যা করে। তবে এ ঘটনায় ২৭ জন সাধারণ নাগরিক, ট্রেনের চালক ও একজন আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হন। সেনাবাহিনীর মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক জেনারেল আহমেদ শরীফ এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
বিএলএ: ইতিহাস ও উদ্দেশ্য
বেলুচিস্তান পাকিস্তানের বৃহত্তম, কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে কম ঘনত্বের প্রদেশ। অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, যেখানে কয়লা, সোনা, তামা ও প্রাকৃতিক গ্যাস রয়েছে। তবে এটি পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলের একটি।
বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) পাকিস্তানের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, যা স্বাধীন বেলুচিস্তান রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে এবং ২০০০-এর দশকে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাদের দাবি, পাকিস্তান বেলুচিস্তানের সম্পদ শোষণ করছে এবং স্থানীয় জনগণকে বঞ্চিত করছে।
বিএলএ-এর মূল দাবি ও লক্ষ্য
✅ স্বাধীন বেলুচিস্তান: অন্যান্য বেলুচ জাতীয়তাবাদী দল যেখানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে, বিএলএ সেখানে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে লড়াই করছে।
✅ প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা: সংগঠনের দাবি, বেলুচিস্তানের বিপুল খনিজ সম্পদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বেলুচ জনগণের হাতে থাকা উচিত।
✅ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) ও গওয়াদার প্রকল্পের বিরোধিতা: বিএলএ মনে করে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন ও পাকিস্তান যৌথভাবে বেলুচিস্তানের সম্পদ লুট করছে।
✅ পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের প্রতিশোধ: পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বেলুচিস্তানে সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে, যার ফলে বহু বেলুচ নাগরিক নিখোঁজ বা নিহত হয়েছে। বিএলএ এই দমননীতির জবাবে সশস্ত্র প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।
বিএলএ-এর নেতৃত্ব ও কৌশল
শুরুর দিকে বিএলএ-এর নেতৃত্ব ছিল মাররি উপজাতির হাতে। বর্তমানে এটি শিক্ষিত বেলুচদের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে।
📌 বশির জায়ব বালোচ: ২০১৮ সালে আসলাম বালোচ নিহত হওয়ার পর বিএলএ-এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
📌 হাম্মাল রেহান: বিএলএ-এর ‘মজিদ ব্রিগেড’ নামে পরিচিত আত্মঘাতী ইউনিটের প্রধান।
📌 রেহমান গুল: পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য, বর্তমানে বিদ্রোহীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
বিএলএ-এর অর্থায়ন ও সহযোগিতা
বিএলএ-এর অর্থের মূল উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংগঠনটি অর্থ সংগ্রহ করে—
🔸 মাদক পাচার ও চোরাচালানের মাধ্যমে
🔸 কয়লা খনি থেকে অবৈধ টোল আদায় করে
🔸 বিচ্ছিন্নতাবাদী বেলুচ অভিবাসীদের অনুদান থেকে
🔸 চীনা প্রকল্পের ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে
পাকিস্তান সরকার বারবার অভিযোগ করেছে যে ভারত বিএলএ-কে সমর্থন ও অর্থায়ন করছে, তবে এর পক্ষে শক্ত কোনো প্রমাণ নেই।
বিএলএ-এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণ
বিএলএ তরুণদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। সংগঠনটি উচ্চশিক্ষিত বেলুচদের অন্তর্ভুক্ত করছে এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে তাদের প্রতি সমর্থন তৈরি করছে।
📌 পাকিস্তানি সরকারের অব্যবস্থাপনা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
📌 বেলুচ নিখোঁজ ব্যক্তিদের আন্দোলনের ফলে তরুণদের সশস্ত্র সংগ্রামে ঝুঁকে পড়া
📌 বিএলএ-এর হামলার ভিডিও ও বিবৃতি সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা
ভবিষ্যতে বিএলএ-এর ভূমিকা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিএলএ তাদের হামলার মাত্রা ক্রমাগত বাড়িয়েছে। তারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি চীনা প্রকল্পগুলোকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে।
📌 ২০২৩ সালে সংগঠনটি ১৫০টিরও বেশি হামলা চালিয়েছে, যার বেশিরভাগই পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী ও চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে।
📌 চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিএলএ বিদ্রোহীরা একটি বাস থামিয়ে সাতজন পাঞ্জাবি যাত্রীকে হত্যা করে।
📌 ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে কোয়েটার প্রধান রেলস্টেশনে একটি বোমা হামলায় ১৪ জন সেনাসদস্যসহ ২৬ জন নিহত হন।
পাকিস্তানের দমননীতি ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিএলএ দমনে কঠোর অভিযান চালাচ্ছে এবং দাবি করছে, সংগঠনটির শক্তি দুর্বল হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, যদি—
✅ পাকিস্তান সরকার বেলুচিস্তানের উন্নয়ন, মানবাধিকার রক্ষা ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত না করে
✅ বেলুচ জনগণের প্রতি বঞ্চনার নীতি চালিয়ে যায়
তাহলে ভবিষ্যতে বিএলএ-এর মতো সংগঠন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান নীতির উপর নির্ভর করছে, এই সংঘাত আরও তীব্র হবে নাকি সমাধানের পথ খুঁজে পাবে।