
ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য শাস্তির আইন পাশ করতে হবে: মির্জা ফখরুল
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের শোকবার্তা ও বক্তব্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় তুলে ধরে। এতে তিনি ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান ঘটনা, প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক পটভূমির আলোকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। তার বক্তব্যকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়:
১. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা
মির্জা ফখরুল বলেছেন, দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে এবং নারী ও শিশু নির্যাতন এখন ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। তার এই বক্তব্য বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক বর্বরোচিত ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে।
রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে, প্রশ্ন হলো—বর্তমান প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা কার্যকরভাবে এটি করতে পারছে? অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় না আনা, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা এবং প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপের কারণে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। ফলে অপরাধীরা সাহস পাচ্ছে এবং নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছে।
২. ধর্ষণের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা
বিএনপি মহাসচিব বর্তমান পরিস্থিতিকে “বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের অনৈতিক শাসনের ধারাবাহিকতা” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি স্পষ্টতই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং প্রশাসনের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করেছেন।
তিনি দাবি করেছেন, দেশে নিয়মিত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, কিন্তু ভুক্তভোগীরা সামাজিক লজ্জা বা প্রশাসনিক সহায়তার অভাবে তা প্রকাশ করতে ভয় পান। এই বক্তব্যও বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়, কারণ বাংলাদেশে ধর্ষণের পর অনেক ভুক্তভোগী বিচার পান না বা নানাভাবে হেনস্তার শিকার হন।
তবে, ধর্ষণ বা নারী নির্যাতন কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সময় বা সরকারের একক ব্যর্থতার ফল নয়। এটি একটি দীর্ঘদিনের সামাজিক ব্যাধি, যা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
৩. প্রকাশ্য শাস্তি ও আইনের সংস্কারের আহ্বান
মির্জা ফখরুল ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য শাস্তির দাবি জানিয়েছেন এবং বলেছেন, একটি বৈধ সংসদে এ নিয়ে আইন পাস করতে হবে। ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধের কঠোর শাস্তির দাবিতে সাধারণ জনগণও বারবার সোচ্চার হয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো—প্রকাশ্য শাস্তি কার্যকর সমাধান হবে কি না?
বর্তমানে বাংলাদেশের ধর্ষণবিরোধী আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়েছে, কিন্তু এর কার্যকর প্রয়োগ এবং দ্রুত বিচার না হওয়াই মূল সমস্যা। প্রকাশ্যে শাস্তির চেয়ে দ্রুত ও নিশ্চিত বিচার এবং নির্ভরযোগ্য আইনি কাঠামো গড়ে তোলা বেশি কার্যকর হতে পারে।
৪. রাজনৈতিক সংহতি ও আইনি সহায়তা
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শিশুটির চিকিৎসা ও আইনি সহায়তার জন্য আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন বলে মির্জা ফখরুল উল্লেখ করেছেন। এটি রাজনৈতিক সংহতির একটি দৃষ্টান্ত। তবে, এটি এক ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণেরও অংশ, যেখানে সরকারবিরোধী দল নিজেদের মানবাধিকারপন্থী হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়।
অন্যদিকে, মির্জা ফখরুল ২০১৮ সালে সুবর্ণচরে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনা উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে, রাজনৈতিক কারণে নারী নির্যাতন ঘটছে এবং এটি অতীতের ঘটনার ধারাবাহিকতা। তবে, অপরাধের বিচার রাজনৈতিক বিবেচনায় না দেখে সামগ্রিকভাবে অপরাধ দমন নীতিকে শক্তিশালী করাই হবে যৌক্তিক সমাধান।
৫. সমাজের অস্থিরতা ও ভবিষ্যৎ করণীয়
তিনি বলেছেন, “সমাজের অস্থিরতার এই সময়ে শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা।” এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিচারহীনতা—এসব কারণে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। ফলে শুধুমাত্র কঠোর শাস্তির আইন নয়, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার প্রসার, নারীর প্রতি সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি, প্রশাসনিক কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই হবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য দেশের ভয়াবহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। ধর্ষণের মতো অপরাধের বিচারহীনতা, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, রাজনৈতিক দোষারোপের সংস্কৃতি এবং আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতাই মূলত এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
কিন্তু এ ধরনের ঘটনা রোধে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, প্রয়োজন কার্যকর নীতিগত পরিবর্তন। সমাজের সব স্তর থেকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, অপরাধীদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে বাধ্য করতে হবে। কেবল তখনই এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে।