July 16, 2025
গল্প- অভিমানের প্রবাস

গল্প- অভিমানের প্রবাস

ফেব্রু ১৮, ২০২৫

বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে

রাত তখন প্রায় তিনটা। লন্ডনের এক বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের জানালার পাশে বসে রুদ্র (ছদ্মনাম) এক মনে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঘন তুষারপাত হচ্ছে, চারপাশে ধবধবে সাদা বরফ জমেছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সেগুলো চকচক করছে, যেন নীরবতার এক অপার সৌন্দর্য।

কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। মাথার মধ্যে এক অদ্ভুত শূন্যতা নিয়ে বসে আছে। শীতের এই কনকনে হিম বাতাসও যেন তার বুকের ভেতরের হিমশীতল কষ্টের কাছে হার মানছে।

পাশের ঘরে রেশমা ঘুমিয়ে আছে। তার নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে।

এই শহর, এই জীবন—সবকিছুই এখন রুদ্রের চেনা। বিদেশের মাটিতে সে এখন প্রতিষ্ঠিত, নিরাপদ, স্বচ্ছল। অথচ এই রাতগুলোতে একবার না একবার ঠিকই মনে পড়ে সেই রাতের কথা—যেদিন তারা দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

কত অভিমান ছিল মনে! কত অপমানের গ্লানি জমা ছিল বুকের ভেতর!

বিমানবন্দরে পা রাখার মুহূর্তে মনে হয়েছিল—সবাই জিতে গেছে, কেবল সে-ই হেরে গেছে।

কিন্তু সত্যিই কি সে হেরেছে?

রুদ্র ছোটবেলা থেকেই ছিল অসম্ভব মেধাবী। ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্র, শিক্ষকদের প্রিয়, বন্ধুবান্ধবদের অনুপ্রেরণা। সে সবসময় বড় স্বপ্ন দেখত। প্রযুক্তি নিয়ে তার ছিল দারুণ আগ্রহ। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকেই তার স্বপ্ন ছিল নিজের একটা সফটওয়্যার কোম্পানি বানাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই সে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছিল। রাত জেগে কোডিং করা, ক্লায়েন্টের কাজ শেষ করা, নিজেকে আপগ্রেড করা—এসবের মধ্যেই তার দিন-রাত কেটে যেত।

অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সে পরিচিত হয়ে ওঠে। নতুন নতুন প্রযুক্তি শিখে, উদ্ভাবনী আইডিয়া কাজে লাগিয়ে একটা স্টার্টআপ শুরু করে বন্ধুদের নিয়ে।

শুরুটা কঠিন ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার কোম্পানি জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে, বড় বড় কোম্পানি তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু করে। সংবাদপত্রে তার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়, তরুণ প্রজন্ম তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়।

সব কিছুই ঠিক পথে এগোচ্ছিল।

কিন্তু সফল হলেই কি সব সহজ হয়ে যায়?

সমস্যা শুরু হলো যখন রুদ্রের সাফল্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আশেপাশের অনেকের মধ্যে হিংসার আগুন জ্বলে উঠল।

প্রতিযোগীরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করল। রাজনৈতিক নেতাদের নজর পড়ল তার ওপর। কিছু অসৎ ব্যক্তি তার ব্যবসাকে কাজে লাগাতে চাইলো, কিন্তু রুদ্র নীতিবান ছিল, সে দুর্নীতির সঙ্গে আপস করেনি।

এরপর থেকেই তার জন্য বাধা আসতে শুরু করল।

সরকারি দপ্তর থেকে কোম্পানির নানা কাগজপত্রে সমস্যা বের করা হলো, অনুমোদন পেতে সময় নেওয়া হলো, নানা অজুহাতে তার ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে কাজ সরিয়ে নেওয়া হলো।

এক সময় ব্যাংকেও তার লোনের আবেদন বারবার আটকে যেতে লাগল। তার প্রজেক্টগুলোতে অযথা জটিলতা তৈরি করা হলো।

এদিকে, প্রতিযোগীরা তার কর্মীদের লোভ দেখিয়ে সরিয়ে নিতে শুরু করল। তার কিছু কাছের লোকও বিশ্বাসঘাতকতা করল, তাকে পেছনে ফেলে অন্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিল।

ধীরে ধীরে বিনিয়োগকারীরা একে একে সরে যেতে লাগল।

রুদ্র চারদিকে ছুটোছুটি করতে লাগল, নতুন করে কোম্পানি বাঁচানোর জন্য চেষ্টা চালাল। কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করল না।

কত মানুষের পাশে সে দাঁড়িয়েছিল, অথচ তার বিপদের দিনে কেউ এগিয়ে আসেনি।

সে কি এত সহজে হাল ছাড়বে?

না, রুদ্র সিদ্ধান্ত নিল—সে আবার শুরু করবে।

পুরোপুরি ভেঙে না পড়ে সে নতুন উদ্যমে চেষ্টা করল ঘুরে দাঁড়ানোর। কিছু পুরোনো ক্লায়েন্ট তখনও তার ওপর বিশ্বাস রেখেছিল, কিছু কর্মী তখনও পাশে ছিল। তাই নতুন করে শুরু করল ছোট পরিসরে, আগের চেয়ে দ্বিগুণ পরিশ্রম নিয়ে।

কিন্তু শুরু থেকে আবার শুরু করা সহজ ছিল না। প্রতিদিন নতুন নতুন বাধা আসতে লাগল।

ব্যবসার জন্য ব্যাংকে গেলে শুনতে হতো, “আগে তো বেশ ভালো করছিলেন, হঠাৎ এত সমস্যা কেন?”

কিছু বিনিয়োগকারী পেছনে বলত, “ও তো শেষ, আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না।”

এভাবে চলতে চলতে একসময় রুদ্র বুঝতে পারল—এই দেশ তার জন্য নয়।

অবশেষে, কর্মীদের সব বেতন পরিশোধ করে, পাওনাদারদের টাকা দিয়ে, শেষ করে দিল বাংলাদেশের অধ্যায়।

যেদিন অফিসের চাবি শেষবারের মতো টেবিলে রেখে বেরিয়ে আসছিল, মনে হয়েছিল—এটা কি তার ব্যর্থতা? নাকি এটাও একধরনের জয়, যেখানে সে অন্তত কারও কাছে ঋণী হয়ে থাকেনি?

আজ পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে।

রুদ্র এখন লন্ডনে, নতুনভাবে শুরু করেছে। নিজের যোগ্যতায় এক বড় সফটওয়্যার কোম্পানিতে ভালো একটা পদে কাজ করছে। অর্থনৈতিকভাবে সে এখন বেশ শক্ত অবস্থানে আছে।

আজ রুদ্র আবারও সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে। তাকে নিয়ে আলোচনা হয়, তাকে নিয়ে গর্ব করা হয়। অথচ সে জানে, বিপদের সময় কতজনের কত রূপ দেখেছে!

তাই এখন আর প্রশংসা, ভালোবাসা, আন্তরিকতা আর বিশ্বাস হয় না তার।

সে বুঝে গেছে—এই ভালোবাসা তাকে নয়, তার আর্থিক অবস্থাকে।

সে এখন প্রশংসা শুনলে মনে মনে হাসে।

দেশের খবর মাঝেমধ্যে পত্রিকায় চোখে পড়ে। নতুন কিছু তরুণ উদ্যোক্তা উঠে আসছে, কিন্তু সেখানেও রাজনীতি, দুর্নীতি আর অন্যায়ের ছায়া স্পষ্ট।

রুদ্র জানে, তার মতো আরও অনেকেই একদিন বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়বে।

আর এইভাবেই একে একে মেধারা হারিয়ে যাবে, অভিমানে, হতাশায়, বাধ্য হয়ে।

দেশ কি একদিন শূন্য হয়ে যাবে?

মেধাবীরা কি আর ফিরে আসবে না?

এই প্রশ্নের উত্তর আজও অজানাই থেকে যায়…

Leave a Reply