
গাজায় জাতিগত নিধন এড়িয়ে চলতে বললেন জাতিসংঘ মহাসচিব
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানকে (Two-State Solution) আদর্শ পথ হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা দখল ও ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত পরিকল্পনা নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এ প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জাতিগত নিধন এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
১. ট্রাম্পের পরিকল্পনা ও তার প্রভাব
📌 ট্রাম্পের পরিকল্পনার মূল বিষয়বস্তু:
- গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন না করে তাদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া।
- গাজা উপত্যকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে নেওয়ার সম্ভাবনা।
📌 সম্ভাব্য প্রভাব:
✅ ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয় পরিচয়ের ওপর হুমকি:
ফিলিস্তিনিরা গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের অংশ মনে করে। তাদের অন্যত্র সরিয়ে দিলে তাদের জাতীয় পরিচয় বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
✅ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে:
ট্রাম্পের পরিকল্পনা আরব দেশগুলো বিশেষ করে জর্ডান, মিসর ও লেবাননের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে।
✅ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব আরও জটিল হবে:
ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করলে তারা আরও বিপজ্জনক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, যা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা নষ্ট করবে।
২. জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসের প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের বৈঠকে গুতেরেস বলেন—
🔹 “সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আমরা আরও সংকট তৈরি করতে পারি না।”
🔹 “আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি মেনে চলা জরুরি এবং যেকোনো জাতিগত নিধন অবশ্যই এড়িয়ে যাওয়া উচিত।”
🔹 “গাজা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এটি দখল বা পুনর্বাসনের পরিকল্পনা অগ্রহণযোগ্য।”
📌 গুতেরেসের মূল বার্তা:
✅ দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানই শান্তির একমাত্র উপায়।
✅ ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে সরিয়ে নেওয়া অগ্রহণযোগ্য।
✅ ইসরায়েলকে দখলদারি বন্ধ করতে হবে।
৩. আরব বিশ্ব ও ফিলিস্তিনি নেতাদের প্রতিক্রিয়া
📌 ফিলিস্তিনি দূত রিয়াদ মনসুরের প্রতিক্রিয়া:
🔹 “গাজা আমাদের দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা গাজা ছেড়ে যাব না।”
🔹 “পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের পূর্বপুরুষের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারবে না।”
🔹 “আমরা গাজাকে পুনর্গঠন করতে চাই, বিশ্বের কাছে আমাদের সাহায্য চাচ্ছি।”
📌 জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহর ভূমিকা:
🔹 তিনি আগামী সপ্তাহে ওয়াশিংটন সফর করবেন এবং আরব দেশগুলোর যৌথ বার্তা ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেবেন।
📌 জাতিসংঘের দীর্ঘমেয়াদী অবস্থান:
জাতিসংঘ সবসময় দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের পক্ষে থেকেছে, যেখানে
✅ ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে।
✅ পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে স্বীকৃত হবে।
৪. ইতিহাস ও বাস্তবতা: গাজার ভূরাজনীতি
📌 ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ ও দখল
- ইসরায়েল পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা দখল করে।
- ২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করলেও, এর সীমান্ত ও বন্দর নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে।
- গাজার দক্ষিণ অংশ মিসর নিয়ন্ত্রণ করে।
📌 হামাসের উত্থান ও সংকট
- ২০০৭ সালে হামাস গাজায় সরকার গঠন করে।
- গাজা পূর্ণ অবরোধের (blockade) মধ্যে পড়ে, ফলে অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
📌 ইসরায়েল-মিসর-যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থান
- ইসরায়েল গাজাকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে।
- মিসরও হামাসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।
- যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রধানত ইসরায়েলপন্থী।
৫. গাজার ভবিষ্যৎ: কি হতে পারে?
📌 সম্ভাব্য ৩টি দৃশ্যপট
✅ (১) দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান বাস্তবায়ন (আদর্শ কিন্তু দুরূহ)
- ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
- ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন পাশাপাশি বসবাস করবে।
- এটি জাতিসংঘ ও আরব বিশ্বের পছন্দের সমাধান।
🚨 (২) ট্রাম্পের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন (বিপজ্জনক)
- গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়া হবে।
- এটি প্রতিরোধ ও সহিংসতা বাড়াবে এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার জন্ম দেবে।
⚠ (৩) চলমান সংকট অব্যাহত (বর্তমান বাস্তবতা)
- ইসরায়েল গাজাকে অবরুদ্ধ রেখেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে।
- ফিলিস্তিনি জনগণ মানবিক সংকটে থাকবে।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ
📌 ট্রাম্পের পরিকল্পনা ফিলিস্তিনিদের জাতীয় পরিচয়কে হুমকির মুখে ফেলছে এবং এটি বাস্তবায়িত হলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধের সূত্রপাত হতে পারে।
📌 জাতিসংঘ ও আরব বিশ্ব দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের পক্ষে থাকলেও, ইসরায়েলের আধিপত্যবাদী নীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে এটি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে।
📌 ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক কূটনীতি, আরব বিশ্ব এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের ওপর নির্ভর করবে গাজার ভবিষ্যৎ।
👉 একমাত্র টেকসই সমাধান হলো আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম এর অংশ থাকবে।