
ইসলামি দলগুলোকে পক্ষে আনার চেষ্টায় বিএনপি ও জামায়াত
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক মেরুকরণ স্পষ্টতই গভীর হচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা লক্ষণীয়। বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (চরমোনাই পীর) সঙ্গে জামায়াত ও বিএনপির ধারাবাহিক বৈঠক রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিএনপি-ইসলামী আন্দোলন বৈঠকের প্রসঙ্গ
গত ২৯ জানুয়ারি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে বৈঠক করেন। পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এই বৈঠক ছিল বিএনপির দূরত্ব কমানোর কৌশলের অংশ। বৈঠকের পর ১০টি বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর ঘোষণা দেওয়া হয়।
বৈঠকের লক্ষ্য:
- দূরত্ব কমিয়ে সম্পর্কোন্নয়ন:
ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপিকে উদ্দেশ করে দেওয়া সমালোচনামূলক বক্তব্য থামানো এবং দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা বাড়ানো। - ঐক্য গঠন:
ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা এবং ইসলামি শরিয়াহবিরোধী কোনো নীতিতে একমত না হওয়া। - নির্বাচনপূর্ব প্রস্তুতি:
জামায়াতের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের সম্প্রতি গড়ে ওঠা ঘনিষ্ঠতার প্রেক্ষাপটে ইসলামী আন্দোলনকে বিএনপির দিকে আনতে উদ্যোগ।
১০টি যৌথ সিদ্ধান্ত:
বিএনপি ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে আলোচিত ১০টি বিষয় ছিল—
- আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদমুক্ত স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
- দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, অর্থ পাচারকারী ও খুনিদের বিচারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।
- দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
- ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে আক্রমণ না করা।
- ইসলামি শরিয়াহবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া।
- বর্তমান প্রশাসনে থাকা আওয়ামী লীগের দোসরদের দ্রুত অপসারণ।
- প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর দ্রুততম সময়ে নির্বাচন আয়োজন।
জামায়াতের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের ঘনিষ্ঠতা ও বিএনপির কৌশল
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বরিশালে চরমোনাইয়ের পীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার এক সপ্তাহ পর বিএনপি একই পথে এগিয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে ইসলামি দলগুলোকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার।
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের সম্পর্ক:
জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে ‘সংস্কার আগে, পরে নির্বাচন’ এবং ‘আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন’ বিষয়ে একমত হয়েছে। যদিও বিএনপি এসব বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে।
বিএনপির অবস্থান:
বিএনপি আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির বিরোধিতা করে বলেছে, এতে আসনভিত্তিক প্রার্থী না থাকায় ভোটারদের অংশগ্রহণ কমে যাবে।
বিএনপি-ইসলামী আন্দোলনের মতপার্থক্য
- নির্বাচনের সময়কাল:
ইসলামী আন্দোলন প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর ১–১.৫ বছরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে। বিএনপি দ্রুততম সময়ে (জুলাই–আগস্ট) নির্বাচন চায়। - আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন:
ইসলামী আন্দোলন এই পদ্ধতির পক্ষে। বিএনপির মতে, এটি ভোটারদের আগ্রহ কমিয়ে দেবে।
রাজনৈতিক মেরুকরণ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ঐক্যের সম্ভাবনা:
ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মে বিএনপি ও ইসলামি দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। তবে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের সম্পর্কের উন্নয়ন এবং বিএনপির কৌশলগত উদ্যোগ এ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা:
ইসলামী আন্দোলনের নেতারা জামায়াতকে দোষারোপ করায় তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। বিএনপি এই দ্বন্দ্ব কাজে লাগিয়ে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে।
ক্ষমতার ভারসাম্য:
নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামি দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গঠনের চেষ্টা রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তবে তা কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করছে দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সমঝোতার ওপর।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর গুরুত্ব বরাবরই উল্লেখযোগ্য। বিএনপি ও জামায়াতের ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা নির্বাচনী কৌশল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা বাস্তবায়ন সহজ হবে না। মতপার্থক্য, আস্থার সংকট এবং ক্ষমতার মেরুকরণ ঐক্য গঠনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।