কৃষক থেকে রাষ্ট্রনায়ক, মানবতার প্রতীক থেকে নশ্বর বিদায় : জিমি কার্টার
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী জিমি কার্টারের মৃত্যু একটি যুগের অবসান ঘটিয়েছে। গত রোববার জর্জিয়ার প্লেইনস-এর বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার প্রয়াণ কেবল আমেরিকান রাজনীতির জন্য নয়, বিশ্বশান্তি ও মানবাধিকার আন্দোলনের জন্যও একটি অপূরণীয় ক্ষতি।
অসাধারণ জীবনের পথচলা
১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর জর্জিয়ার প্লেইনসে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জিমি কার্টার। একজন সাধারণ কৃষকের সন্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার গল্প যেমন অনুপ্রেরণাদায়ক, তেমনই বিরল। নেভাল একাডেমি থেকে স্নাতক পাসের পর পারমাণবিক সাবমেরিন কর্মসূচিতে কাজ করা কার্টার পরবর্তীতে পরিবারের বাদাম চাষের ব্যবসা দেখভাল করেন। এখান থেকেই তিনি তার সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন।
রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে চ্যালেঞ্জপূর্ণ সময়
১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া জিমি কার্টারের শাসনকাল ছিল চ্যালেঞ্জে ভরা। অর্থনৈতিক মন্দা, ইরানের জিম্মি সংকট এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক উত্তেজনার সময় তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। এক মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে ১৯৮০ সালের নির্বাচনে রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে পরাজিত হয়ে হোয়াইট হাউস ছাড়তে বাধ্য হন।
তবে, তার নেতৃত্বে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি হয়েছিল, যা মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মানবিক কর্মকাণ্ডের অগ্রদূত
রাষ্ট্রপতি পদ ছাড়ার পর জিমি কার্টার তার জীবন উৎসর্গ করেন মানবিক কর্মকাণ্ডে। দারিদ্র্য হ্রাস, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, এবং আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার কাজ আজও অনুপ্রেরণার উৎস। ২০০২ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
পারিবারিক জীবন ও ব্যক্তিত্ব
জিমি কার্টার ও তার স্ত্রী রোসালিনের দাম্পত্য জীবন দীর্ঘ ৭৭ বছরের। তাদের সম্পর্ক ভালোবাসা, সমর্থন এবং মানবিক কাজের এক দৃষ্টান্ত। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কার্টার তার পরিবার এবং বিশ্বাসের সঙ্গে ছিলেন। তিনি একজন শক্তিশালী নৈতিক চেতনার নেতা ছিলেন, যা তার রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত জীবনে স্পষ্ট ছিল।
শেষ অধ্যায়
জীবনের শেষ কয়েক বছর জিমি কার্টার ত্বকের ক্যানসারসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। তবে, চিকিৎসার পরিবর্তে পরিবারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। গত অক্টোবরেই তিনি ১০০তম জন্মদিন উদ্যাপন করেছিলেন।
বিশ্ববাসীর জন্য অনুপ্রেরণা
জিমি কার্টার কেবল একজন রাজনীতিকই ছিলেন না; তিনি ছিলেন মানবতা, নৈতিকতা এবং শান্তির প্রতীক। তার ছেলে চিপ কার্টারের কথায়, “আমার বাবা কেবল আমাদের নয়, যেকোনো শান্তিকামী মানুষের জন্য একজন নায়ক ছিলেন।”
জিমি কার্টারের জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় আমাদের শিখিয়ে যায়, একজন ব্যক্তি তার কঠোর পরিশ্রম, সততা এবং নৈতিক চেতনার মাধ্যমে কিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। যদিও তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সফলতার স্বর্ণচূড়া স্পর্শ করতে পারেননি, কিন্তু একজন মানুষ এবং মানবতার সেবক হিসেবে তার অবদান অনস্বীকার্য।
জিমি কার্টারের মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে শক্তিশালী নেতৃত্ব কেবল ক্ষমতায় নয়, মানবিকতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নৈতিক মূল্যে নিহিত।