নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব, সীমাবদ্ধতা ও সংস্কার চিন্তা
জাতীয় সংসদ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সাংবিধানিক দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। এ দায়িত্ব পালনে ইসি মাঠ পর্যায়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজন করে। নির্বাচনী কার্যক্রমে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তা প্রতিরোধ ও শাস্তির জন্য বিভিন্ন আইন ও বিধান রয়েছে। তবে ইসি নিজেই অপরাধে জড়ালে কী হবে, সে বিষয়ে বিদ্যমান আইনে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই।
নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণের বিধান
সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণের পদ্ধতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের অনুরূপ। বর্তমানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। অতীতে এ ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল।
বিতর্কিত নির্বাচন ও কমিশনের দায়
গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ইসিকে দায়বদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা সামনে এনেছে।
- ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন
- ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’ নির্বাচন
- ২০২৪ সালের জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন
এসব নির্বাচনে ইসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষত, কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম এবং অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোনো কমিশনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সংস্কার কমিশনের গঠন ও কার্যক্রম
২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করে।
সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম:
- অংশীজনদের মতবিনিময়
- সাধারণ মানুষের মতামত গ্রহণ
- রাজনৈতিক দলগুলোর লিখিত প্রস্তাব সংগ্রহ
- বিদ্যমান আইন ও বিধি পর্যালোচনা
প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। তবে প্রতিবেদন এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
দায়বদ্ধতার প্রস্তাব
সংস্কার কমিশন মনে করছে, নির্বাচন কমিশনারদের নির্বাচনী অপরাধের জন্য দায়বদ্ধ করার ব্যবস্থা প্রয়োজন।
প্রস্তাবিত ব্যবস্থা:
- আরপিওতে (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সংশোধন এনে কমিশনারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের সুযোগ তৈরি।
- গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়ার পদ্ধতি নির্ধারণ।
বদিউল আলম মজুমদারের বক্তব্য:
“গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউ দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নন। সংবিধান সমুন্নত রাখতে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা শপথ ভঙ্গ করলে তাঁদের দায়বদ্ধ করার ব্যবস্থা থাকা উচিত।”
ক্ষমতা বৃদ্ধি ও আইনি সংশোধনের চিন্তা
ইসির ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়েও চিন্তাভাবনা চলছে।
- ইসির অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বিষয়টি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা।
- ভোট বন্ধের ক্ষমতা তফসিল ঘোষণার পর থেকে কার্যকর করার প্রস্তাব।
- নির্বাচনী অপরাধে মামলা করার সময়সীমা (বর্তমানে ৬ মাস) বাড়ানো বা তুলে দেওয়া।
প্রতিক্রিয়া
- বিএনপির অবস্থান: প্রতিবেদন প্রকাশের পর মন্তব্য করবে।
- গণতন্ত্র মঞ্চের অবস্থান: দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা সমর্থন করবে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “ইসির স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দায়বদ্ধতা বাড়ানোর প্রয়োজন। তবে কোনো কমিটি করে দায়বদ্ধতার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ইসির স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, তা বিবেচনা করতে হবে।”
নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ ও কার্যকর করতে আইনি কাঠামো ও ক্ষমতায়ন জরুরি। এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।