আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তির বিষয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ আদেশ প্রকাশ
ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ আদেশ প্রকাশিত হওয়ায় এটি দেশের জ্বালানি খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গত ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট এই চুক্তির বৈধতা ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অনুসন্ধান কমিটি গঠন, চুক্তির প্রক্রিয়া ও নেগোশিয়েশন তথ্যের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করা এবং বিদ্যুৎ খরচের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে আরও স্পষ্টতা প্রদান। এই আদেশের মাধ্যমে আদালত সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ও সংশ্লিষ্ট তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চাপ সৃষ্টি করেছে।
হাইকোর্টের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা:
- উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অনুসন্ধান কমিটি গঠন: আদালত নির্দেশ দিয়েছে, ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বরের আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক জ্বালানি ও আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অনুসন্ধান কমিটি গঠন করতে। এই কমিটি এক মাসের মধ্যে চুক্তি সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবে এবং ৬০ দিনের মধ্যে চুক্তির বৈধতা নিয়ে অনুসন্ধান করবে। এতে চুক্তি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে।
- প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে কি না তা যাচাই: আদালত সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, চুক্তি সম্পাদনে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে। চুক্তির স্বচ্ছতা ও বৈধতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে হবে।
- চুক্তি প্রক্রিয়া ও নেগোশিয়েশন তথ্য: চুক্তি সম্পাদনের আগে যদি কোনো নেগোশিয়েশন বা দর-কষাকষি আলোচনা হয়ে থাকে, তবে সে-সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালতের আদেশ অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যানকে এসব তথ্য ৩০ দিনের মধ্যে দাখিল করতে হবে।
আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির বিষয়ে বিতর্ক
বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তা মূলত চুক্তির শর্তাবলী ও দর-কষাকষির স্বচ্ছতার অভাবকে কেন্দ্র করে। রিট আবেদনকারী আইনজীবী এম আবদুল কাইয়ূমের ভাষ্যে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ ভারতের অন্যান্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ অনেক কম দামে কিনতে পারে, কিন্তু আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে প্রতি ইউনিট খরচ অনেক বেশি পড়ছে—১৪ টাকা প্রতি ইউনিট।
তবে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে খরচ অনেক কম—ভারতীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে ৫ দশমিক ৫ টাকা এবং বেসরকারি খাত থেকে ৮ টাকা ৫০ পয়সা খরচ হয় প্রতি ইউনিটে। এর contrast হিসেবে আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তির শর্ত এবং দাম বিশেষভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
চুক্তির স্বচ্ছতা নিয়ে সংশয়
আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষ করে নেগোশিয়েশন প্রক্রিয়া সম্পর্কে। গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যে, চুক্তির দর-কষাকষি যথাযথভাবে হয়নি এবং এ নিয়ে কোনও স্পষ্ট তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। সেজন্য আদালত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছে।
এছাড়া, অন্য দেশের—যেমন নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে খরচ প্রতি ইউনিট ৮ টাকা হলেও আদানির থেকে এই খরচ অনেক বেশি হওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর ফলে, বিদ্যুৎ খরচের অযথা বৃদ্ধি নিয়ে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে, এবং এটি সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ব্যাখ্যার দাবি তুলছে।
সরকারের পদক্ষেপের গুরুত্ব
এই আদেশ সরকারের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অনুসন্ধান কমিটি গঠন ও চুক্তির স্বচ্ছতা পর্যালোচনা করার মাধ্যমে সরকারের পক্ষে চুক্তির বৈধতা নিশ্চিত করার সুযোগ এসেছে। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে যদি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা হয় বা যদি আদালতের নির্দেশনা যথাযথভাবে পালিত না হয়, তবে এটি ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের আইনি ও রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
এছাড়া, বিদ্যুৎ খরচের ব্যাপারে সরকারের ব্যাখ্যা এবং চুক্তির শর্তসমূহের স্বচ্ছতা প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা থাকলে জনগণের মধ্যে আস্থার পুনর্নির্মাণ সম্ভব। তাই, সরকারের পক্ষ থেকে আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই আদেশের মাধ্যমে আদালত নিশ্চিত করতে চেয়েছে যে, আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির শর্তগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা এবং চুক্তি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল কিনা, তা জনগণের কাছে পরিষ্কার হবে। সরকার যদি আদালতের নির্দেশনা মেনে চলে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়, তবে বিদ্যুৎ খাতের ন্যায্যতা ও সচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যা দেশের জন্য একটি বড় সুবিধা বয়ে আনবে।