হাসিনার বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও কেন বিমান পাঠায়নি ভারত
বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কমই দেখা গেছে, যখন একজন প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। বিশেষত, যখন সেই প্রধানমন্ত্রীকে ‘আয়রন লেডি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তিনি প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে ক্ষমতায় ছিলেন। তবুও, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যান, এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে। তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে নানা নাটকীয়তা ও কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, যা বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে।
১. শেখ হাসিনার নিরাপত্তাহীনতা ও ভারতীয় সাহায্যের অনুরোধ
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও তার দলের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনবিক্ষোভ এবং সেনাবাহিনীর সমর্থন হারানোর পর, তিনি জীবনের নিরাপত্তার জন্য ভারতের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। হাসিনা ভারতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে একাধিকবার ফোন করেন, এবং তাকে জানান যে, ঢাকায় তাকে আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না। তিনি বলেছিলেন, “এই মুহূর্তে আমার সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। জনগণ ও সেনাবাহিনী আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে, তাই জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়তে হবে।”
তার অনুরোধ ছিল, ভারত যেন একটি বিমান পাঠায় যাতে তিনি নিরাপদে ভারতে চলে যেতে পারেন। তবে, হাসিনার এই অনুরোধের পরও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোনো বিমান পাঠায়নি।
২. ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ও কূটনৈতিক যুক্তি
ভারত বিমান পাঠাতে রাজি না হওয়ার পেছনে কূটনৈতিক কারণে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। ভারতের নেতারা যুক্তি দিয়েছিলেন, একটি তৃতীয় দেশ, বিশেষত ভারত, যদি বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপত্তার নামে উদ্ধার করে, তাহলে তা আন্তর্জাতিক মহলে দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ইতিহাসে ভারতীয় পদক্ষেপটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হতে পারে, যা আন্তর্জাতিক সমালোচনার জন্ম দিতে পারে।
এছাড়া, ভারতীয় সরকারের কাছে একটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল—তাদের প্রমাণ করতে হবে যে, বাংলাদেশই তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য চাপ দিয়েছে, এবং তারা স্রেফ একটি কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে। ফলে, বাংলাদেশ সরকারকে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হয়, এবং হাসিনাকে দেশ ছাড়তে সহায়তা করার জন্য ভারত কোনো সরাসরি উদ্যোগ নেয়নি।
৩. হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া
ভারতের বিমান পাঠানোর অনুরোধে সাড়া না পাওয়ার পর, হাসিনা নিজে সিদ্ধান্ত নেন এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় নিজস্ব বিমানে দিল্লি চলে যান। শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা যখন দেশ ছাড়েন, তখন পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ ছিল, এবং সেনাবাহিনীও তাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল। নিরাপত্তা বাহিনী বুঝতে পারছিল না, যদি শেখ হাসিনাকে ক্যাম্প বা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে জনতার প্রতিরোধ মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।
৪. ভারতের কূটনৈতিক সংকট ও ‘ভারত-বিরোধিতা’
ভারত বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে উদ্ধার করতে যাবে এমন সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছিল না, কারণ ভারতীয় নেতৃত্ব জানত, এর ফলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত-বিরোধী মনোভাব আরও তীব্র হতে পারে। বাংলাদেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বিরোধিতা অনেক পুরনো, এবং এমনকি গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী অনুভূতি আরও শক্তিশালী হয়েছে।
৫. হাসিনার লেখাটি: অজানা রহস্য
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার আগে একটি তিন পৃষ্ঠার লেখা লিখেছিলেন এবং তা নিজের সঙ্গে নিয়ে দিল্লি পৌঁছান। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কিংবা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কিছু নির্দেশনা থাকতে পারে। হাসিনার কিছু বিশ্বস্ত সহকর্মীর সাথে ফোনালাপের পর, ওই লেখার বিষয়ে বেশ কিছু আলোচনা হলেও, তা এখনও সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পায়নি।
৬. ভারতের হুমকি ও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতা
ভারতীয় কূটনৈতিক সূত্রে জানানো হয়, বাংলাদেশ যদি শেখ হাসিনাকে দ্রুত না পাঠায়, তাহলে ভারত বিকল্প ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা ভাবনা করছিল। তবে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতা ও পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি দেখে, শেষমেশ হাসিনাকে বিদেশে পাঠানো হয়।
শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার ঘটনা এবং ভারতীয় ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অস্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনার পেছনে একাধিক কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, ও নিরাপত্তা বিষয়ক সিদ্ধান্ত ছিল, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভবিষ্যত প্রভাবিত করতে পারে। বাংলাদেশের জনগণের প্রতিক্রিয়া এবং ভারতের অবস্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।