ব্যাংক থেকে লুট করা টাকা এখন খেলাপির খাতায়
সরকারের বদলের পর বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা গত তিন মাসে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বেড়েছে। বিশেষভাবে, ইসলামী ব্যাংকসহ কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, এবং বড় শিল্পগোষ্ঠী যেমন বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা গ্রুপসহ আরও অনেকের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।
বিগত সরকারের সময়ে ঋণের অবস্থা
এ তথ্য থেকে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, আগের সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনা এবং অস্বচ্ছ ঋণ নীতির ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক ঋণ পাচার এবং নানা কৌশলে ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছিল, যা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। ২০১৯ সালে একটি অদ্ভুত নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে বর্তমান সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ঋণের হিসাব পুনর্বিবেচনা করেছে, যার ফলে প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসছে।
খেলাপি ঋণের বিশ্লেষণ
ব্যাংক খাতের বিভিন্ন সূত্র এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। জুন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১২.৫৬ শতাংশ ছিল। ২০০৯ সালে, যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, যা এখন অনেক গুণ বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা এবং অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন যে, ওই সময়ে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
ব্যাংক খাতে গোপনীয়তা ও অবলোপন
ব্যাংক খাতের শীর্ষ নির্বাহীরা মনে করেন, খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আরও বেশি হতে পারে, কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী কিছু ঋণ অবলোপন বা আদালতের আদেশে স্থগিত রাখা ঋণ হিসাবের মধ্যে নেই। এছাড়া অনেক ঋণ পুনঃতফশিল করা হয়েছে, যা এই হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এসব কারণে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ
সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক খাতে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছে, যার ফলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আরও পরিষ্কার হতে পারে। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বাংলাদেশ ব্যাংক, এখন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় দুর্বল ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষা চলছে।
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, “২০১৯ সালে একটি অদ্ভুত নীতিমালা করে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানো হয়েছিল, যা প্রকৃত চিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। এখন আন্তর্জাতিক মানে নিরীক্ষণ শুরু হলে প্রকৃত পরিস্থিতি বের হয়ে আসবে।”
সংস্কার প্রয়োজন
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ব্যাংক খাতে সংস্কারের জন্য আরও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তারা বলছেন, সংকটপূর্ণ ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা দূর করতে এবং খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের করে আনতে স্বচ্ছতার প্রয়োজন। সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এই খাতে বাস্তবসম্মত ও কার্যকরী সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, তবে তা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
নিরীক্ষা ও পরবর্তী পদক্ষেপ
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক খাতের দুর্বলতা কাটাতে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় নিরীক্ষণ শুরু করেছে এবং প্রতিটি ব্যাংককে তাদের নিজস্ব উদ্যোগে নিরীক্ষণ পরিচালনা করার পরামর্শ দিয়েছে। সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, “এই ধরনের নিরীক্ষণের মাধ্যমে প্রকৃত পরিস্থিতি বের হয়ে আসবে, যা পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সহায়ক হবে।”
অবশেষে, বর্তমান সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক খাতে যে সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা যদি সুচারুরূপে বাস্তবায়িত হয়, তবে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আরও পরিষ্কার হবে এবং সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। তবে, এসব সংস্কারের সফলতা নির্ভর করছে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ এবং স্বচ্ছতার ওপর, যা দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।