যুবসমাজ নতুন বাংলাদেশ তৈরির পথে আমাদের পরিচালিত করেছে: ড. ইউনূস
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তৃতা এবং তার আহ্বান বিশ্লেষণ করলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসে যা বৈশ্বিক এবং দেশীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার বক্তব্য থেকে যে মূল বার্তাগুলি প্রতিফলিত হয় তা হলো:
ইউনূস তার বক্তৃতায় একটি নতুন পৃথিবী গড়ার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যেখানে সামাজিক ন্যায়, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্তর্ভুক্তির ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যত গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেন, “যদি আমরা একসঙ্গে কল্পনা করতে পারি, তাহলে সেটি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।” অর্থাৎ, তার মতে, পৃথিবী পরিবর্তন হতে পারে যদি সবাই একযোগে একটি নতুন পৃথিবী কল্পনা করে এবং সেটি বাস্তবায়নের জন্য একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে। এটি একটি সহনশীল, ন্যায়সংগত এবং পরিবেশবান্ধব পৃথিবী গড়ার অভিপ্রায়।
ইউনূসের মতে, বাংলাদেশের যুবসমাজ দেশের উন্নয়ন ও পরিবর্তনের পথনির্দেশক। তিনি উল্লেখ করেন, “আমাদের দেশ তরুণদের দেশ। ১৭১ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ২৭ বছরের নিচে।” যুবসমাজের এই শক্তি দেশের অর্থনীতি, সমাজ এবং পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সৃজনশীলতা এবং উদ্যোক্তা মনোভাবের মাধ্যমে পরিবেশগত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্ভব। তবে এজন্য যুবকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ দেওয়া জরুরি, যাতে তারা চাকরিপ্রার্থী না হয়ে উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারে।
ইউনূস জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে তুলে ধরেছেন, বিশেষত বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগণের জন্য। তিনি বলেন, “আমাদের অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের ফ্রন্টলাইনে রয়েছে।” জলবায়ু পরিবর্তন, বর্ধিত পানি এবং বদলে যাওয়া আবহাওয়ার কারণে উপকূলীয় জনগণের জীবন, ঘরবাড়ি এবং জীবিকা হুমকির মুখে। তিনি দ্রুত এবং ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান, যা একটি টেকসই এবং পরিবেশগতভাবে নিরাপদ পৃথিবী গড়ার জন্য প্রয়োজন।
ইউনূস যে অর্থনীতির কথা বলেছেন, তা হলো এমন একটি অর্থনীতি যেখানে শূন্য বেকারত্ব, শূন্য সম্পদের কেন্দ্রীকরণ এবং শূন্য কার্বন নির্গমন থাকবে। এই “শূন্য” ধারণাটি তিনি পৃথিবী গড়ার মূল স্তম্ভ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি সামাজিক ব্যবসা প্রচলনের কথা বলেন, যেখানে ব্যবসা শুধু মুনাফার জন্য নয়, বরং মানুষের সমস্যার সমাধানেও মনোযোগী হবে। সামাজিক ব্যবসা এমন একটি মডেল হতে পারে যা বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর সমাধান করবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে হবে।
ইউনূস বর্তমান সভ্যতাকে ব্যর্থ বলে মন্তব্য করেছেন, কারণ এটি পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মধ্বংসী এবং আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পদের চরম সঞ্চয় ঘটাচ্ছে। এজন্য তিনি একটি নতুন সভ্যতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যেখানে মানবতার কল্যাণ এবং পরিবেশের সুরক্ষা প্রধান অগ্রাধিকার হবে। তিনি বাংলাদেশের সহনশীলতার উদাহরণ দিয়েছেন, যেখানে প্রতিকূলতার মুখে সাহস ও সংহতির মাধ্যমে সমস্যা মোকাবিলা করা হয়েছে।
ইউনূস তার বক্তৃতায় বর্তমান পৃথিবীর বিভক্তি এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, “এ বছর সম্মেলনের বিষয়বস্তু, ‘একটি বিভক্ত বিশ্ব’ গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।” অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অন্যায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব এক ধরনের সংকটে পতিত হয়েছে। তবে তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ সহনশীলতা এবং প্রতিকূলতা থেকে উত্তরণের একটি উদাহরণ এবং এমন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে।
অধ্যাপক ইউনূসের বক্তৃতা একটি শক্তিশালী কলঙ্কমুক্ত, পরিবেশবান্ধব এবং সামাজিকভাবে ন্যায়সঙ্গত অর্থনৈতিক মডেল তৈরির আহ্বান ছিল। তিনি তরুণদের নেতৃত্বে একটি নতুন সভ্যতা গড়ার জন্য যে শক্তিশালী সম্ভাবনার কথা বলেছেন, তা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তার মতে, এই পরিবর্তন আসবে একে অপরকে সমর্থন এবং সাহস যোগানোর মাধ্যমে, যা বিশ্বকে একটি সহনশীল এবং সমানভাবে উন্নত স্থান করে তুলবে।