র্যাব ছেলের সম্পৃক্ততার কথা বললেও পুলিশের তদন্তে এল ভিন্ন তথ্য, আদালতে একজনের জবানবন্দি
বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। উম্মে সালমা (৫০) নামের এক গৃহবধূকে দিনদুপুরে তার বাড়িতে ঢুকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় এবং পরে লাশটি ডিপ ফ্রিজে গুম করা হয়। হত্যার ঘটনা প্রথমে ‘ডাকাতি’ হিসেবে চিহ্নিত হলেও, পুলিশ এবং র্যাবের তদন্তে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে উদঘাটিত হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ:
আসামিরা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন ডাকাতি করতে গিয়ে গৃহবধূ উম্মে সালমাকে হত্যা করার। তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, উম্মে সালমার বাসার চারতলা ফ্ল্যাটের ভাড়াটে মাবিয়া সুলতানা, তার সহযোগী মোসলেম উদ্দিন ও সুমন রবিদাস এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। মাবিয়া সুলতানার বাসায় নানা ধরনের লোকের যাতায়াত থাকত, যা নিয়ে উম্মে সালমা তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। এ কারণে মাবিয়া ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং মাদক ব্যবসায়ী সুমন রবিদাসের সঙ্গে মিলিত হয়ে উম্মে সালমাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
হত্যার ঘটনা:
ঘটনার দিন, উম্মে সালমাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। মোসলেম উদ্দিন এবং তার সহযোগীরা হত্যার পর লাশটি ডিপ ফ্রিজে রাখেন এবং ঘটনাকে ডাকাতির ঘটনা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করেন। তারা বাসার আলমারিতে কুড়াল রেখে, তালা দিয়ে বাইরে চলে যান। পরবর্তীতে সাদ, উম্মে সালমার ছেলে, তার বাবাকে ফোন করে জানায় যে, মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাদ, অন্যদের সঙ্গে মিলে খোঁজাখুঁজির নাটক তৈরি করেন। শেষে সাদ নিজেই ডিপ ফ্রিজের ঢাকনা খুলে লাশ বের করেন এবং ডাকাতির নাটক সাজান।
তদন্তের অগ্রগতি:
প্রাথমিকভাবে সাদকে হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে, পরবর্তীতে সিসিটিভি ফুটেজ এবং অন্যান্য প্রমাণের মাধ্যমে তার সরাসরি হত্যায় জড়িত না থাকার তথ্য উঠে আসে। তদন্তে নতুন গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে মোসলেম উদ্দিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, যেখানে তিনি হত্যার পুরো পরিকল্পনা এবং ঘটনাটির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর জবানবন্দি অনুযায়ী, মাবিয়া সুলতানা এবং সুমন রবিদাসের সঙ্গে তিনি একযোগে উম্মে সালমাকে হত্যা করেন।
গ্রেপ্তার এবং আলামত:
মাবিয়া সুলতানা, মোসলেম উদ্দিন ও সুমন রবিদাসের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। মাবিয়া সুলতানার বাসা থেকে উম্মে সালমার ফ্ল্যাটের চাবি এবং মোসলেম উদ্দিনের বাড়ি থেকে ইন্টারনেট রাউটার উদ্ধার করা হয়েছে, যা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে। গ্রেপ্তার আসামিরা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করেছেন এবং ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
তদন্তের জট:
এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সিসিটিভি ফুটেজ, তথ্যপ্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এতে দেখা যায় যে, ঘটনার দিন নতুন গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন আসামি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তবে, সাদ বিন আজিজুর রহমান, উম্মে সালমার ছোট ছেলে, তার মায়ের হত্যায় জড়িত নন বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।
নীতিগত এবং সমাজিক শিক্ষা:
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে গভীর পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা রয়েছে, তা সমাজের জন্য একটি বড় শিক্ষা। অর্থনৈতিক বা পারিবারিক ক্ষোভের কারণে এমন অমানবিক ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা পরবর্তীতে গোটা পরিবার এবং সমাজের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করে।
পরবর্তী পদক্ষেপ:
তদন্ত এখনও চলমান রয়েছে এবং পুলিশ ও র্যাব যৌথভাবে কাজ করে হত্যার রহস্য পুরোপুরি উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে, তদন্তের আরো কিছু দিক পরিষ্কার হলে, বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে।
এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে একদিকে পারিবারিক সমস্যা, অন্যদিকে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং অর্থনৈতিক লোভের ফলে সংঘটিত হওয়া এক ভয়াবহ হত্যার ঘটনা উঠে এসেছে, যা আমাদের সমাজে সম্পর্কের গুরুত্ব এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চাপে সচেতনতা তৈরির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করে।