December 23, 2024
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ১০০ দিন: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ১০০ দিন: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

নভে ১০, ২০২৪

প্রতিটি নতুন সরকারের প্রথম ১০০ দিনকে ‘হানিমুন পিরিয়ড’ বলা হয়ে থাকে। এ সময় জনগণ ও বিশেষজ্ঞরা সরকারের কর্মসূচি এবং পরিকল্পনা পর্যালোচনা করে বুঝতে চেষ্টা করেন, তারা কোন পথে এগোতে চায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ে তারা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে আগের শেখ হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া বিশাল ঋণের বোঝা এবং অর্থনৈতিক সংকট এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।

আর্থিক চ্যালেঞ্জ: ঋণ, মূল্যস্ফীতি এবং বিনিয়োগের স্থবিরতা

শেখ হাসিনা সরকারের মেয়াদ শেষে বাংলাদেশ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ক্ষমতা ছাড়ার সময় ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ রেখে যায় তারা। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আর্থিক খাতে সংস্কারের ঘোষণা দিলেও, রাজস্ব আদায় থেকে শুরু করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখনও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি দেখা যায়নি।

অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০.৮৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১২.৬৬ শতাংশে ঠেকেছে। এই লাগামহীন মূল্যস্ফীতি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার তিনবার বাড়ালেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যত তেমন অগ্রগতি হয়নি।

এদিকে, ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তবে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি ৩.৯৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আগের বছর ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। এই প্রবৃদ্ধির পতন কর্মসংস্থানের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

ব্যাংকিং খাত: লুটপাট এবং আস্থার সংকট

বিগত সরকারের আমলে ব্যাংকিং খাত ছিল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট করে তা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যার মধ্যে এস আলম গ্রুপের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নতুন সরকার পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সক্রিয় হয়েছে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি এবং জটিল প্রক্রিয়া।

খেলাপি ঋণ এখন ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে গ্রাহকের আস্থা পুনরুদ্ধার এখনো কঠিন চ্যালেঞ্জ।

রপ্তানি ও রেমিট্যান্স: সংকটের মধ্যেও কিছুটা আশার আলো

রপ্তানি খাতে সংকট থাকলেও সম্প্রতি কিছু ইতিবাচক দিক দেখা যাচ্ছে। অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয় আগের বছরের তুলনায় ১৯ শতাংশ বেড়েছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গ্যাস সংকটের কারণে অনেক ক্রয়াদেশ কমে গেছে, যা ভবিষ্যৎ রপ্তানিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

অন্যদিকে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ছে। এটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে রয়েছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং করণীয়

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের সময়োপযোগী এবং কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। রাজস্ব আদায় বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) সংস্কার জরুরি। পাশাপাশি, বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্লেষক ড. মঈনুল ইসলাম মনে করেন, আর্থিক খাতে গঠিত কমিশনগুলো সময়মতো কার্যকর ফল দিতে পারলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। একইভাবে, রপ্তানি খাতে পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে এবং প্রবাসী আয়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

অন্যদিকে, টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর পাশাপাশি নতুন অর্থ পাচার রোধেও শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ১০০ দিনে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চলছে, কিন্তু চ্যালেঞ্জগুলোও বিশাল। মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং ব্যাংকিং খাতের আস্থাহীনতা কাটিয়ে উঠতে হলে দীর্ঘমেয়াদি এবং সুসংগঠিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

Leave a Reply