৭১ এর ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম দেশের ইতিহাসের অন্যতম গৌরবময় অধ্যায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এই দুটি ঘটনা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা অর্জন করে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করে স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠা করেন।
অন্যদিকে, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ত্যাগ ও আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করতে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে কিছু অভ্যন্তরীণ শক্তি কাজ করেছিল, যার মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ছিল একটি প্রভাবশালী নাম। এই দলটির তৎকালীন নেতারা পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তিকামী বাঙালিদের ওপর সহিংসতার জন্য দায়ী ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের ভূমিকা এবং স্বাধীনতা বিরোধী কার্যকলাপের কারণে আজও অনেকের কাছে জামায়াতে ইসলামী একটি বিতর্কিত দল হিসেবে রয়ে গেছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার ভূমিকার কারণে তাদের প্রতি একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বহমান, যা প্রজন্মান্তরে উত্তরাধিকার হিসেবে চলছে। যদিও জামায়াতের তৎকালীন নেতৃত্ব আজ আর জীবিত নেই, তবে দলটির ওপর এই ইতিহাসগত দায় এখনো বর্তমান নেতৃত্বের উপর প্রভাব বিস্তার করে। তাই অনেকেই মনে করেন, জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বের উচিত ১৯৭১ সালে সংগঠনের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া। এমনটি করলে তা শুধুমাত্র তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে না, বরং জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি করবে। অনেকের মতে, জামায়াত যদি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দায় স্বীকার করে এবং তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে, তবে জনগণের কাছে দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে এটিও উল্লেখযোগ্য যে, স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের ওপর ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে জামায়াতের কয়েকজন নেতাকে ফাঁসির দণ্ড প্রদান করা হয়। মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, কাদের মোল্লা, এবং কামরুজ্জামানের বিচারের কার্যক্রম নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছিল। বিশেষ করে, বিচারকদের স্কাইপে কথোপকথনের অডিও ফাঁস হওয়ার পর অনেকেই এই বিচারের প্রক্রিয়া ও নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। এই কারণে, এ রায়গুলো দেশের বৃহৎ অংশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অন্যদিকে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়কালে জামায়াতের দুইজন মন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেন, যাদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি প্রমাণিত হয়নি। দেশের মানুষের কাছে এটি একটি ইতিবাচক উদাহরণ হিসেবে আলোচিত হয়, যা তাদের সুনামের সহায়ক হয়েছে। সব মিলিয়ে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামী একটি বিতর্কিত দল হলেও মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা প্রার্থনা জাতির মধ্যে একটি ঐক্যের বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। একইসঙ্গে এটি জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যতেও নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সহায়ক হতে পারে, যা জাতীয় ইতিহাসে তাদের দায়বদ্ধতা পূরণের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে।
–মাহমুদুল হাসান সাগর (লন্ডন, যুক্তরাজ্য )