পারমাণবিক বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয় কীভাবে?
পারমাণবিক বোমা নিরস্ত্রীকরণ একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া যা বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত এবং কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত হয়। পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস বা নিষ্ক্রিয় করার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এ প্রক্রিয়ার প্রধান ধাপগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
১. পারমাণবিক বোমা খোলা এবং নিষ্ক্রিয়করণ:
প্রথম ধাপ হলো বোমার বিভিন্ন অংশ খুলে ফেলা। বিশেষজ্ঞরা খুব সাবধানে পারমাণবিক অস্ত্রের প্লুটোনিয়াম বা ইউরেনিয়াম কোর থেকে ডেটোনেটর বা বিস্ফোরক অংশগুলো আলাদা করেন। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া, কারণ সামান্য ভুলের কারণে বিপজ্জনক বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
২. নিউক্লিয়ার ম্যাটেরিয়াল রেন্ডারিং হার্মলেস:
পারমাণবিক অস্ত্রে ব্যবহৃত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় নিষ্ক্রিয় করা হয় যাতে এই উপাদানগুলো পুনরায় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা না যায়। এর মাধ্যমে উপাদানগুলোকে নিরাপদে সংরক্ষণ বা পুনঃব্যবহার উপযোগী করা হয়।
৩. ডিলিউশন বা হ্রাস প্রক্রিয়া:
উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামকে কমমাত্রায় মিশিয়ে সাধারণ জ্বালানি হিসাবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ইউরেনিয়ামকে এমনভাবে হ্রাস করা হয়, যাতে এটি পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা গেলেও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
৪. ভিট্রিফিকেশন বা গ্লাসিফিকেশন:
ধ্বংসকৃত পারমাণবিক উপাদানকে গ্লাসের মতো কঠিন পদার্থে রূপান্তরিত করা হয়, যা সুরক্ষিতভাবে সংরক্ষণ করা যায় এবং পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর হয়। এটি পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।
৫. রোবটিক প্রযুক্তির ব্যবহার:
পারমাণবিক বোমা নিষ্ক্রিয় করার সময় সরাসরি মানুষ জড়িত থাকলে জীবনের ঝুঁকি থাকে। তাই রোবট এবং রিমোট কন্ট্রোল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বোমার বিস্ফোরক অংশগুলো আলাদা এবং নিষ্ক্রিয় করা হয়। রোবটগুলো অত্যন্ত নিখুঁতভাবে কাজ করতে সক্ষম, যা মানুষকে বিপজ্জনক পদার্থ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে।
৬. রেডিয়েশন শনাক্তকরণ ও নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি:
পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের সময় তেজস্ক্রিয়তা নির্গত হয়। রেডিয়েশন শনাক্তকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে তেজস্ক্রিয় উপাদানের অবস্থান ও মাত্রা নির্ণয় করা হয়। বিশেষ ডিভাইস ব্যবহার করে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
৭. প্লাজমা প্রযুক্তি:
প্লাজমা প্রযুক্তির মাধ্যমে উচ্চ তাপমাত্রায় পারমাণবিক বোমার ধাতু ও অন্যান্য উপাদান গলিয়ে ধ্বংস করা হয়, যাতে বোমার কার্যক্ষম অংশগুলো পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করা যায়।
৮. মনিটরিং ও নিরাপত্তা:
নিরস্ত্রীকরণের সময় সার্বক্ষণিক নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার রাখা হয়। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মনিটরিং সিস্টেম ব্যবহার করে নিশ্চিত করে যে নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
৯. আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া:
প্রযুক্তির পাশাপাশি পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ সফল করতে আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফারেশন ট্রিটি (NPT) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তি পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা কমাতে এবং নিরস্ত্রীকরণকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক।
এই প্রক্রিয়াগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হলে পারমাণবিক অস্ত্র নিষ্ক্রিয়করণ সম্ভব হয়, যা বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।