মব ট্রায়াল বনাম মানবাধিকার
ইসলামের নবী (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে খুলনায় ৪ সেপ্টেম্বর রাতে কিশোর উৎসব মণ্ডলকে থানায় পুলিশ, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে গণপিটুনির শিকার হতে হয়। তার জীবিত না মৃত হওয়ার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই জানা যায়, তার বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে তিনটি ধারায় মামলা হয়েছে।
গণপিটুনি একটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দেশের সকল নাগরিক আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। তবে উৎসব মণ্ডল তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই পুলিশের উপস্থিতিতে আইনের আশ্রয় পায়নি, বরং তাকে নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির ক্ষতি করার কোনো ব্যবস্থা আইন ছাড়া গ্রহণ করা যাবে না। এ ছাড়া, মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ৩, ৫, ৭ ও ১৯ উৎসব মণ্ডলের ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হয়েছে।
অন্যদিকে, উৎসব মণ্ডল এমন একটি আইনের আওতায় আসামি হয়েছে, যার বাতিল চেয়ে নাগরিক সমাজ বহুদিন ধরে আন্দোলন করছে। এই আইনকে দমনমূলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং সরকারের অনেকেই এ আন্দোলনে সহমত পোষণ করেছিলেন। কিন্তু উৎসবের বাবা-মা যাদের নিরাপত্তার ওপর ভরসা করেছিলেন, তাদের হেফাজতেও উৎসব সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা পায়নি।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, গুরুতর আহত উৎসব সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন। তার জীবন রক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রশংসনীয়। তবে কিশোরটির পরিবার ঘটনার পর থেকে ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার পিতা কর্মস্থলে যাননি, মোবাইল ফোনও বন্ধ রেখেছেন। ৭ সেপ্টেম্বর উৎসবের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, সেটি তালাবদ্ধ। তার কাকা জানিয়েছেন, পরিবারটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এমনকি উৎসবের গ্রামের বাড়িতেও হামলার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যা এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় রোধ করা সম্ভব হয়েছে।
গণপিটুনির ঘটনায় দেশে কোনো পৃথক আইন নেই। সাধারণত দণ্ডবিধির আওতায় মামলা হয়, তবে শত শত লোক এ ধরনের ঘটনায় অংশ নেওয়ায় প্রকৃত অপরাধী শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। আলামত নষ্ট হওয়া এবং সাক্ষীর অভাব সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। যদিও সাক্ষ্য আইনে এখন ভিডিও, ছবি, অডিও গ্রহণযোগ্য প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়, তবু উৎসব মণ্ডলকে গণপিটুনিতে যারা মারধর করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলম বলেছেন, মব ট্রায়াল কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই বছরে ৭৭টি গণপিটুনির ঘটনায় ৬২ জন নিহত এবং ৫৪ জন আহত হয়েছেন। আগস্ট মাসেই ২০টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যাতে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় নিহতদের বেশিরভাগই নিরীহ মানুষ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
গণপিটুনির সংখ্যা বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থী ও জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর ফলে পুলিশের ওপর মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, যা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে।
বিচারহীনতার কারণে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াকে স্বাভাবিক মনে করছে, যা আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি। এই অবস্থার উত্তরণে দ্রুত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং পরিবার ও সমাজে মানবাধিকার চর্চা ও সংস্কৃতি বিকাশে রাষ্ট্রের কার্যকর ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। আশা করা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার গণপিটুনি বা মব ট্রায়াল প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে এবং কোনো উৎসবের পরিবারে আর কখনও বিষাদের ছায়া নেমে আসবে না।